এখন নানান ধরনের রোগ ব্যাধি হচ্ছে
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘উপকূলীয় আমাদের এলাকাতে আগে বিভিন্ন ধরনরে প্রাণী ভরা ছিলো। প্রত্যেক বাড়িতে পালিত হতো নানান ধরনের গবাদি পশু। এখানে ছিলো বিভিন্ন রঙের গরু, ছাগল, বিভিন্ন জাতের হাঁস মুরগি, কবুতর, ঘোড়া, মহিস, ষাঁড়। এছাড়াও এসকল পশুর সাথে বাড়িতে পোষ মানানো হতো শালিক, ময়না, ঘুঘু, বক, টিয়া সহ নানান প্রাণী। এমন কোন বাড়ি ছিলো না যে বাড়িতে ২০-২৫টির উপরে কোন না কোন গবাদি পশু থাকতো। প্রত্যেক পরিবারে অনেকগুলো করে ছিলো বলে এগুলোকে আমরা পাল বলতাম। কেউ শুনলে বলতাম যে এটি ওমুকের গরুর পাল, মহিসের পাল এভাবে বলতাম। আর এখন পালের তো দূরের কথা কিছু কিছু বাড়িতে শুধু ২-৪টি করে হাঁস মুরগি ছাড়া আর কিছু নেই। আগে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা তিন বেলায় যেন এসকল গবাদি পশুদের লালন পালন করে দিনের সময়ের অধ্যেক চলে যেতো।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলেন শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের শংকরকাটি গ্রামের কৃষাণী নাজমা বেগম। তিনি আরও বলেন, ‘গবাদি সেসকল পশুকে নানান ধরনের নামে ডাকা হতো এবং তাদের সাথে মানুসের যেন একধরেনর গভীর সম্পর্ক ছিলো। বাড়ি থেকে নানান ধরনরে পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যেতো। এ থেকে মানুষের রোগবালাই ছিলো অনেক কম। যতই দিন যাচ্ছে যেন গবাদি প্রাণী সম্পদ কমতে শুরু করেছে। যার জন্য এখন নানান ধরনের রোগ ব্যধি হচ্ছে। যা শুধু পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার কারণে।’
সম্প্রতি বারসিক’র সহায়তায় শংকরকাটি কৃষি নারী সংগঠনের উদ্যোগে কৃষাণী নাজমা বেগমের বাড়িতে লবণাক্ততা ও গবাদি প্রাণী সম্পদের সমস্যা বিষয়ক অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আক্ষেপ করে এ কথা বলেছেন কৃষাণী নাজমা বেগম। আালোচনা সভায় শংকরকাটি গ্রামের কৃষক, কৃষাণী, শিক্ষার্থী বারসিক কর্মকর্তাসহ মোট ১৮ জন অংশগ্রহণ করেন।
সভায় অংশগ্রহণকারী নারী শামীমা, আয়েশা ও মাছুরারা জানান, আগে গবাদি পশু বেশি ছিলো আর এখন কমছে। তার কারণ হলো এখন খাদ্য ঘাটতি, খাদ্যের মূল্য বেশি, পানিতে লবণাক্ততা বেশি, কৃষি জমি কমে যাওয়াতে গবাদি পশুর চারণভূমি কমে গেছে। এতে করে মানুষ যেমন পুষ্টিকর খাবার খেতে পাচ্ছে না তেমনি গবাদি পশুরও পুষ্টিকর খাবারের অভাব দেখা দিচ্ছে। তারা আরো জানান, এখন গবাদি পশুর নানান ধরনের রোগ ব্যাধি হচ্ছে যেমন জ¦র, রানী ক্ষেত, গলা ফুলা, উকুন, পাতলা পায়খানা ও কৃমি রোগ। সাথে আছে হঠাৎ করে মড়ক লাগা যাতে বাড়ি থেকে শুরুর করে একসাথে গ্রামের সব গবাদি পশুপাখি মারা যাচ্ছে। এছাড়া এখন প্রায় ছাগল ভেড়ার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা হলো মৃত বাচ্চা প্রসাব করা। মানুষেরও নানান ধরনের রোগ ব্যাধি হচ্ছে। নাম জানা অজানা কত রকমের রোগবালাই যে হচ্ছে এখন।
অন্য অংশগ্রহণকারী জানান, ‘লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে যেমন গবাদি পশু কমে যাচ্ছে, তেমনি গবাদি পশুপাখি যা আছে তার উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। আগে দেশি গরুতে প্রায় ২ কেজি দুধ পাওয়া যেতো আর এখন কোন মতে ২৫০-৫০০ গ্রাম করে হচ্ছে। গবাদি পশুর প্রজনন কমে যাচ্ছে, ডিম উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আগে প্রত্যেক মুরগি থেকে ২০-২২০টি ডিম পাওয়া যেতো আরো এখন ১৩-১৫টি করে পাওয়া যাচ্ছে। সঠিক সময়ে বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে না। তারা আরও জানান, লবণাক্ততা সাথে গবাদি পশু ও ফসল উৎপাদনের জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হচ্ছে। তার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে গেছে। শুধু ফসলে নয় গবাদি পশুর খাদ্যেও সার কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে যেনো কোন খাবার আর খাবার ভেজালমুক্ত নয়; সব যেন বিষে ভরা। এখন আর আগের সেই দই, ঘি, মাখন আর পাওয়া যাচ্ছে না।
অংশগ্রহণকারীরা লবণাক্ততার প্রভাবে প্রাণী সম্পদের এ সমস্যা সমাধান ও রক্ষার জন্য নিজেরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা মনে করেন এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে উপযোগী সময়ে গবাদি পশুর টিকা প্রদান করা, সার কীটনাশক ব্যবহার করে ঘাস না মারা, গবাদি পশু পালন ও পরিচর্যায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ সহায়তা করা, স্থানীয় প্রাণী সম্পদ সহায়তা করা, মিষ্টি পানির আধার সৃষ্টি করা, খাল ও পুকুরে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করা এবং পানি সংরক্ষণে ড্রাম সহায়তা করা।