হস্তশিল্পের কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন নারীরা

মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার
বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীদের উদ্যোগ, কর্মতৎপরতা, লড়াই-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ সবসময়ই নজর আন্দাজ করা হয়। কিন্তু পারিবারিক পরিসরে তাদের অর্থনৈতিক অবদানকে কালেভদ্রেও স্বীকার করা হয় না। তবুও কালে কালে নারীদের কঠোর, কঠিন পরিবর্তনে তাদের বিদ্যা, বুদ্ধি ও উৎকর্ষতায় সভ্যতা এগিয়েছে। পরিবার কিংবা রাষ্ট্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রাকে বেগমান করে। আজকে আমরা তেমনই কিছু সমৃদ্ধির গল্প বলবো।
পারিবারিক পরিসরে অর্জিত জ্ঞান কিভাবে নারীর আত্মমর্যাদার হাতিয়ার হয়ে সমৃদ্ধির পথ রচনা করছে তার গল্প শুনবো বিনোদপুর ঋষিপাড়া গ্রামের উদ্যোগী নারীদের কথা, যারা হস্তশিল্পকে অবলম্বন করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করছেন। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেলে যারা এলাকা বদলে দেবার সার্মথ্য রাখেন।


সিংগাইর উপজেলার বিনোদপুর ্্ঋষিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুবর্ণা রানী দাস (৪৫)। বর্তমানে তার ২ মেয়ে ও এক ছেলে। স্বামী রিকশা চালক, বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এবং মেজো মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী ও ছেলে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে। এমন একসময় ছিল যখন তার এই পুরো পরিবারের খাবারের যোগান দেওয়া অসম্ভব ছিল সেখানে সন্তানদের লেখাপড়া করানো তো বিলাসিতা। কিন্তু বর্তমানে তিনি হাতে বাঁশের তৈরি পলো, ঝাঁকা, টাপা বিক্রি করে প্রতিদিন ৬০০ টাকা করে আয় করছেন। পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। একই গ্রামের দিতি রানী দাস (৩৫) নিজ হাতে তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের রুমাল ও ছোবা বিক্রি করছে যার মূল্য ৮০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত । স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে শ^শুর-শ^াশুড়িসহ ছোট বাচ্চার খরচ যোগানো কঠিন হযে পড়ায় তিনি তার নিজস্ব দক্ষতায় এইসব জিনিস বুনা শুরু করেন। যা তার পরিবারে অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখছে। অপরদিকে একই গ্রামের উদ্যোগী নারী লক্ষী রানী দাস (৩৫) সেলাই কাজের পাশাপাশি জামা-ব্লাউজের ডিজাইন করে প্রতিদিন ২০০-৪০০ টাকা করে আয় করছেন, যা পরিবার ও নিজের খরচ মেটানোর কাজে সহায়ক ভূমিকা রাাখছে। অপরদিকে উদ্যোগী নারি ঝর্ণা রানী দাস (৪৮) লোকায়ত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নারিকেলের পাতার শিসা দিয়ে প্রতিদিন ৫-৬টি করে ঝাড়ু তৈরি করছেন যার বর্তমান বাজার মূল্য ১২০ টাকা করে ।
বিনোদপুর ঋষিপাড়া গ্রামের এই উদ্যোগী নারীরা জানান, এক সময় ছিল যখন পরিবারে দু-মুঠো খাবারের জন্য তাদের অনেকবার ভাবতে হতো। নিজেদের পছন্দসই চাহিদা মেটানো ছিল স্বপ্নের মতো। আর পরিবারের কোন বিষয়ে কথা বলা তো আরও ভয়াবহ। পারিবারিক কোন ধরনের সিদ্ধান্তে কেন নারীদের মতামত নেয়া লাগবে এই ভাবনায় বিভোর থাকতো তারা। কিন্তু বর্তমানে নারীরা তাদের নিজস্ব সম্পদ, জ্ঞান,দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের ব্যয় সাশ্রয়ী কাজের পাশাপাশি উপার্জনমুলক কাজ করে পরিবারে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নিজের ও সন্তাদের পছন্দসই চাহিদা পূরণ করতে পারছেন। এই প্রসঙ্গে সুবণা রানী বলেন, ‘‘আগে পরিবারের যেকোন সিদ্ধান্ত স্বামী নিতো কিন্তু এখন আমাকেও মতামত দিতে বলে, আমিও যে পরিবারেরই একটি অংশ তা এখন বুঝতে পারছে আমার কাজের ও কথার গুরুত্ব বাড়ছে।’


গ্রামের এই উদ্যোগী নারীদের দেখে পাড়ার বাকি নারীরা এই হস্তশিল্পের দিকে ঝুঁকছেন। তারা ভাবছেন, পরিবারের কাজের পাশাপাশি যদি আমরা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত এই সব হস্তশিল্পের কাজগুলো করতে পারি তাহলে পরিবারে অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারবো এবং সেইসাথে আমাদের মর্যাদাও বাড়বে ।
আর হস্তশিল্পের এই উপকরণগুলো পরিবেশবান্ধব হওয়ায় আমাদের এই হস্তশিল্পগুলোর ব্যবহার সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়া উচিত এবং সরকারি সহায়তা পেলে শুধুমাত্র একটি গ্রামের নারীরাই নয়; এই কাজ সর্বস্তরের নারীদের মাঝে আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা রাখি ।

happy wheels 2

Comments