বীজ সংরক্ষণের নিজস্ব পদ্ধতির চর্চাকারী কৃষাণী মালা আক্তার

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
নারী সৃষ্টিশীল। তাঁরা নিত্যনতুন কার্যপন্থা সৃষ্টি করেন। বহু যুগ আগেই সৃষ্টি করেছিলেন আমাদের কৃষিকাজ। এরই ধারাবাহিকতা আজও চলমান। নিজের পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে তাঁরা দিনান্ত পরিশ্রম করেন। একদিকে কায়িক শ্রম অন্যদিকে মেধাশ্রম দিয়ে পরিবার, পরিবেশ, কৃষি, বৈচিত্র্যতা সকল কিছুরই রক্ষণাবেক্ষণ করে যাচ্ছেন।
লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের একজন কৃষাণী মালা আক্তার। স্বামী, দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। লেখাপড়া খুব বেশি হয়নি তাঁর। প্রাথমিকের গ-ি পেরিয়েছিলেন। এরপরই অভিভাবকেরা তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেন। ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও পড়ালেখা আর হয়নি। কৃষক পরিবারে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পর স্বামীর সাথে কৃষিকাজে সহায়তা করতেন।


কয়েক বছর আগে তাঁর স্বামী কাজের আশায় বিদেশ চলে যায়। বাড়িতে কৃষিকাজের আর কেউ নেই। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন কৃষিকাজে। নিজের বাড়ির আঙিনায় ৫শতাংশ জায়গা আছে। এখানেই তিনি তাঁর মতো করে কৃষিকাজ শুরু করেন। একটি বেসরকারী সংগঠনের বীজ সহযোগিতা থেকে প্রাপ্ত বীজ দিয়ে শুরু করেন নতুন যাত্রা।


মালা আক্তারের সব্জি চাষের জায়গায় তিনি মৌসুমভিত্তিক সব্জি চাষ করে থাকেন। ডাটা, মূলা, ঢেঁড়স, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শিম, চালকুমড়া, বরবটি, কাঁকরোল, পুঁইশাক, মরিচ, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ধনিয়া, মৌরি, হলুদ, আদা ইত্যাদি। তাঁকে কোনো কিছুর জন্যই বাজারে যেতে হয়না। বিগত ৪ বছর যাবৎ নিজে নিজে সব্জি চাষ করতে গিয়ে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতাও হযেছে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজের মতো করে কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।


সব্জি চাষের জায়গাটিকে তিনি প্লট আকারে ভাগ করেন এবং সুবিধা ও প্রয়োজন মাফিক সব্জির বীজ রোপণ/বপন করেন। ২০২০ সালে তিনি রসুন চাষের জায়গায় মালচিং (খড়ের আচ্ছাদন) করেন। এতে করে তিনি দেখেন তাঁর অল্প জায়গায় বেশ ভালো ফলন হয়েছে। এবং অতিরিক্ত কুয়াশা বা রোদে তাঁর ফসলের কোনো ক্ষতি হয়নি। এরপর থেকে তিনি এভাবেই রসুনের চাষ করে আসছেন। তাঁর নিজে গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামেও অনেকে এ পদ্ধতিতে রসুন চাষ করে লাভবান হয়েছেন।তিনি চাষকৃত সকল সব্জির বীজ নিজে সংরক্ষণ করেন। এখানেও তিনি নিজস্ব কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করেন। যেমন যে সব্জিটির বীজ সংরক্ষণ করেন, সেটি কখনো মাটিতে রাখেন না। তিনি বলেন, ‘এতে করে বীজের উৎপাদন ক্ষমতা নাকি কমে যায়।’


এছাড়া আলুর বীজ সংরক্ষণেও রয়েছে তাঁর ভিন্ন পদ্ধতি। অনেকের মতো তিনি মাচায় বা ব্যাগে ঝুলিয়ে বীজ সংরক্ষণ করেন না। তিনি একটি মিটসেফ এর তাক্ এ বীজ রাখেন। এতে করে বীজের চারদিক থেকে কুশি বের হয়। তিনি বলেন, ‘বেশি কুশি বাইর হইলে বেশি লাভ। আলুডারে দুই ভাগ কইরা লাগানো যাইবো। কম বীজ দিয়া বেশি জমিন চাষ করণ যাইবো। আবার একটা আস্তা আলু লাগাইলেও সমস্যা নাই। গাছ অইবো বেশি, আলুও ধরবো বেশি”। গতবছরও তিনি এই পদ্ধতিতেই আলুর বীজ সংরক্ষণ করেছিলেন। ফলন পেয়েছিলেন ভালো। নিজেরা খেয়েছেন, বিক্রি করেছেন এবং বীজ সংরক্ষণ করেছেন।


ধুন্দল নামক সব্জিটি অনেকেই মাচাতে চাষ করেন। কিন্তু তিনি রাস্তার পাশে রোপণ করেন। গাছটি যাতে বেশি জায়গা পায় এবং অন্যান্য বড় গাছের আশ্রয় নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। গাছটি যতো লতানো হবে, ফলন ততো বেশি হবে। এবং ধুন্দলগুলো পুষ্ট ও নরম হবে। সংগ্রহ করা যাবে দীর্ঘদিন।


২০২১সালে পাশর্^বর্তী দরুন হাসামপুর গ্রাম থেকে একটিমাত্র বউত্তা শাক এর চারা এনে নিজের জমিতে রোপণ করেছিলেন। সেই গাছের বীজ এখন ছড়িয়ে গেছে আরো ৭টি গ্রামে।কৃষাণী মালা আক্তার শুধু নিজেই চাষ করেন না। অন্যদেরকেও পরামর্শ, বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজের আঙিনাটিকে তিনি ভরে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় সব্জির সম্ভারে।


একজন কৃষক তাঁর নিজস্ব চিন্তা চেতনায় কৃষিকাজকেই প্রসারিত করেন। তাঁর পরিবারের টিকে থাকা নির্ভর করে কৃষির উপর। কিভাবে ফলন বৃদ্ধি করা যায়, কিভাবে অল্প জায়গাকে সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে চাষের আওতায় আনা যায় এধরণের চিন্তা থেকেই মালা আক্তার নিজস্ব পদ্ধতির চর্চা করেন। নিজের পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করেন। একজন কৃষকের এই জ্ঞান, চর্চাকে বারসিক সব সময় শ্রদ্ধা জানায়।

happy wheels 2

Comments