করোনা পরিস্তিতিতে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় অচাষকৃত উদ্ভিদ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

বর্তমান সময়ে করোন ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবী যেনো লকডাউনে পরিণত হযেছে। সমস্ত দোকানপাঠ, অফিস-আদালত, কলকারখানা, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, যাতাযাত এমনকি শ্রমিকদের কাজ পর্য়ন্ত বন্ধ রয়ে গেছে। এতে করে সকল পেশাজীবী মানুষের নানান ধরনের সমস্যার স্বীকার হতে হচ্ছে। যারা বিত্তবান ও প্রভাবশালী; যাদের টাকা পযসা সব কিছু আছে তারা চাইলে কি না কি খেতে পারে। তারাও এখনো   বাজারে যেতে পারছে না। এদের মধ্যে অনেকে হয়তোবা এক মাসের, পনেরো দিনের এমনকি সপ্তাহের খাবার একসাথে কিনে রেখেছে। অথচ যারা নিন্ম শ্রেণীর, জনমজুরী দিয়ে যাদের সংসার চলে তারা সাতদিনের কথা তো দুরের কথা দুএকদিনের খাবার সঞ্চয় করা তাদের কাছে অসম্ভব। অন্যদিকে আবার সব কিছু বন্ধ থাকার কারণে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক ধ্বস হওযার উপক্রম হচ্ছে। এতে করে আমাদের দেশ বাংলাদেশ সেই একই কাতারে। যেখানে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ হলো শ্রমিক সহ নিন্ম আযের মানুষদের নিয়ে।

এই করোনা লকডাউনের মাধ্যমে মানুষ না পারছে শ্রম দিতে, না পারছে ভালো কোন খাবার খেতে। এদিকে আবার এই করোনাকালে নানান ভাবে প্রচারণা হচ্ছে। যে ভিটামিন যুক্ত খাবার বেশি বেশি খেতে কিন্তু সব মানুষের তো আর ভিটামিন যুক্ত খাবার ক্রয় করার সামর্থ নেই। একদিকে মানুষ না পারছে বাজারে যেতে, না পারছে কাজে যেতে, না পারছে ফসল ফলাতে। সব কিছু বন্ধ হযে যাওযাতে নানান ধরনের সমস্যা দেখা দেওয়া শুরু করেছে। সব কিছু মিলিয়ে যেনো খাবারের সংকট দেখা দেওয়া শুরু করেছে। মানুষের কাছে যেনো এখন করোনা প্রতিরোধের চেয়ে যেনো তিন বেলা খাবার খেয়ে বেঁচে থাকাটা অনেক জরুরী। যা কিছু করি, বলিনা কেন সব কিছু তো খাওয়ার জন্য। তাই সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে বেঁচে থাকাটা কঠিন হতে চলেছে।

বর্তমান সমযে মানুষকে যেনো দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য ত্রাণের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। যে কখন কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন ব্যক্তি খাবার সহায়তা করবে সেই পথ পানে বসে থাকা। এটা যেনো আস্তে আস্তে মানুসের নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারিদিকে খাবারের খোঁজ করতে করতে মানুষ যেনো দিশেহারা হযে পড়ছে। এ বিসয়ে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের সমস্যার কথা এবং খাদ্য চাহিদা কিভাবে মিটাচ্ছে সেসব সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন যে, “বর্তমান সময়ে দেশের যে অবস্থা তাতে আমাদের না খেযে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু আমাদের চেয়ে মনে হয় শহরের দরিদ্র মানুষেরা আরো বেশি সমস্যার মধ্যে আছে। কারণ আমরা যারা গ্রামে বাস করি আমরা যেনো তেনো ভাবে যদি একটু চাউল জোগাড় করতে পারি তাহলে আমাদের চলে যাই।চকারণ এখনো গ্রামের আনাচে-কানাচে হওযা আজাবা-অচাষকৃত বুনোশাক সবজী তুলে আমাদের সাজের পর সাজ চলে যায়। তরকারী তেমন একটা কেনা লাগে না। আমাদের গ্রামের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণে এসকল শাকসবজী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে”।

এ বিষয়ে বেতাঙ্গী গ্রামের প্রবীণ কৃষানী করুনা রানী মন্ডল বলেন, “আগে আমাদের এলাকাতে নানান ধরনের কুড়ানো এসকল খোটা শাক পাওয়া যেতো। আমাদের পরিবারের অধিকাংশ মানুষ এগুলো খেতো। এগুলোতে খুবই ভিটামিন। কিন্ত এলাকায় লবণ জলের আনাগোনা আসা যেই শুরু হয়েছে- সেই এগুলো কমতে শুরু করেছে। এছাড়াও এখনকার ছেলে মেয়েরা এর ব্যবহার সম্পর্কেও ভালো জানে না। তারা এগুলো যেনো খেতে চায়না; তারা এখন মাছ মাংসের প্রিয় হয়ে গেছে। আর তার জন্য নানান ধরেনর রোগেপুড়ে মরছে”। একদিকে লবণ পানির প্রবেশ অন্যদিকে ব্যবহার ও গুরুত্ব কমার কারণে এগুলো অনেকটা হারিয়ে যাওযার পথে।

তিনি আরো বলেন যে,“যেমন এগুলোর ব্যবহার একটু কমে গিয়েছিলো।ঠিক সেই সময়ে যে মহামারী করোনা দেখা দিয়েছে এতে সমস্ত ডাক্তাররা নাকি বলছে যে বেশি বেশি ভিটামিন খাও শাকসবজী খাও। আর এতে করে যেনো কুড়ানো এসব বুনো শাকের কদর বেড়ে গেছে। এখন যে যেখান থেকে পারছে তুলে খাচ্ছে”। এছড়াও আটি আটি করে, ভ্যানে ভ্যানে করে এসকল শাক গ্রামের যেকোন স্থান থেকে তুলে নিয়ে যেমন গ্রামে গ্রামে বিক্রি হচ্ছে তেমনি বাজারেও বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ যেন এখন চাষ করা তরকারীর চেয়ে এসব শাকের উপর বেশি ঝুঁকছে এবং গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। আর এখন একটু একটু বৃষ্টি হওযাতে এসকল শাকগুলো একটু বেশি মাত্রায় পাওযা যাচ্ছে। যার জন্য অনেকেই ক্ষেতে পারছে। আর প্রকৃতিতে যা আছে তা তো কখনো শেষ হওয়ারও নয়।

অন্যদিকে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের কৃষানী কুলসুম বেগম বলেন, “আমরা এসকল শাক ভিটামিনের জন্য খাই ঠিক। কিন্তু বর্তমান যে সময় এখন এ সময় খাদ্যের ঘাটতি খুবই। অনেক পরিবার তরকারী কিনতে পারছে না। তারা কিন্তু এই শাক জোগাড় করে তাদের পরিবারের খাদ্য চাহিদা পুরণ করছে। এতে করে একদিকে যেমন পুষ্টি চাহিদা পুরণ হচ্ছে অন্য দিকে খাদ্যের ঘাটতিও পুরণ হচ্ছে। এ শাক না থাকলে আমাদের গ্রামের মানুষের অনেক বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হতো। এগুলো পাচ্ছি বলে কোন রকমে বেঁচে আছি আমরা। এই দুর্য়োগের সময় এ অচাষকৃত উদ্ভিদ আমাদের খুবই উপকার করছে”।

বর্তমান এই করোনাকালে সব কিছু বন্ধ থাকার কারণে যেমন মানুষ কোন কাজ করতে পারছে না। আর এতে করে পরিবারের খাদ্য চাহিদা পুরণ করা যেনো কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্যের জন্য যেনো হাহাকার তৈরি হতে চলেছে। আর সেদিক থেকে খাদ্য চাহিদার ঘাটতি পুরনে কিছুটা হলেও ভুমিকা রাখছে আমাদের অনাদরে অবহেলায় আনাচে কানাচে পরিত্যক্ত জায়গায় জন্মানো নানান ধরনের অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। প্রকৃতির সকল উদ্ভিদ কোনো না কোন গুরুত্ব বহন করে। ঠিক তেমনি আমাদের অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য এ করোনা দুর্য়োগকালে খাদ্য সংকট রোধে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

happy wheels 2

Comments