সুন্দর আগামীর জন্য আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকুক
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
গত কয়েকদিন ধরে যেসকল সংবাদ পাচ্ছি তা আর নেয়া যাচ্ছে না ঠিকমত। মনটাতো বিমর্ষই থাকে, আজ দেখছি শরীরও খারাপ লাগছে। আমার মা ত্রাণকাজে নামার পর থেকেই হা হুতাশ করতেই থাকে। ‘বাবারে একটু কম বের হও, দেখতাছোতো দেশের অবস্থা।’ সে ইতোমধ্যে কয়েকটা ছদগা দিয়ে দিয়েছে। ছোট্টবেলা থেকেই দেখি আমাদের কেউ অসুস্থ হলেই জানের বদলে জান ছদগা দেয় আমার মা। ভিক্ষুককে চাল, মরিচ, লবণ, পেয়াজ আর একটা মুরগী বা কবুতর দিয়ে ছদগা দেয়া হয়। সে অনেক দোয়া করে যায়। যাহোক আমার মায়ের বিশ্বাস, আমিও তা শ্রদ্ধা করি। আচ্ছা আমি আমার মাকে কি বনের মধ্যে ফেলে যেতে পারবো? সে আমাকে ফেলে যেতে পারবে? কিন্তু একজন মাকে টাঙ্গাইলের সখিপুরের বনে ফেলে গেছেন তার সন্তানে। বলেছে, মা তুমি দুই একদিন এখানে থাকো, পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। তাদের বাড়ী শেরপুর। আহ! কি নির্মম। কি যন্ত্রণার! এটা কি ভাবা যায়। এটা কি আমাদের চিরাচরিত সমাজ মানস?
এ সময়ে ময়মনসিংহে একজন ডাক্তার যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন এ ছিলেন তাকে এলাকাবাসী বিতাড়িত করেছে। বাড়ীর মালিক ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন। তিনি এই আচরণে খুবই মর্মাহত।
লাশ পড়ে থাকছে কেউ কাছে যাচ্ছেনা। স্ট্রোক করে একজন রিকসাচালক রাস্তায় ছটফট করতে করতে মরে গেলো একজন মানুষ তাকে হাসপাতালে নেয়ার চিন্তাও করলোনা। বিদেশ থেকে এসেছে এজন্যই তাকে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে এমন ঘটনাও আমরা দেখলাম। আবার একজন ইসলামী চিন্তাবিদের জানাজায় লক্ষাধিক মানুষ সকল নিয়মকানুন না মেনে সমবেত হলো সেটাই আমরা দেখলাম।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা পেশার সাথে যুক্ত মানুষদের বাড়ীওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলছেন। তাদের সাথে করছেন চরম দুর্ব্যবহার। এই আচরণ কি মানুষের? যে ডাক্তাররা আজ আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন আর তাদের সাথে এ আচরণ। অথচ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতোমধ্যে দ্জুন ডাক্তার মৃত্যুবরণ করেছেন আর আক্রান্ত হয়েছেন অসংখ্য ডাক্তার ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। আজকে যদি ডাক্তাররা বলেন যে আমরা আর কোন দায়িত্ব পালন করতে চাইনা, আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? ডাক্তারদের সহযোগিতা ছাড়া এ সংকটে আর কেউ নেই যে পাশে দাড়াতে পারে। অন্যরা দর্শক এক্ষেত্রে আর যতটুকু করার ডাক্তাররাই করতে পারবে।
গতকাল বাসার বাইরে গেলাম একটা জরুরি কাজে। আদাবর এলাকার একটি রাস্তায় প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে, কেউবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে, মানুষ যাচ্ছে গা ঘেষে নির্বিকার ভাবে। একটা গলিতে একাধিক সবজির ভ্যান। কেউ মানছেন না নূন্যতম শারীরিক দূরত্ব। কি হবে আমাদের এ মানুষদের? ফেইসবুকে দেখলাম আমার নিজের জেলার নিজের গ্রামের হাটবাজারে কিভাবে মানুষ ভীড় করে নির্বিকারভাবে বাজার করছেন কিন্তু কোন বিকার নাই তাদের। একজন তার প্রতিবাদ করে ফেইসবুকে একটা ছবি দিয়েছিলো বলে তাকে ডেকে নিয়ে শাসিয়েছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা।
সারাদেশে লুটপাট চলছে। যে যেভাবে পারছে লুট করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার হুশিয়ারি দিলেও কোন কার্যকর পরিবর্তন এখনো দেখা যাচ্ছেনা। বিছানার নিচে থেকে তেলের খনি তেলের মজুদ) বের হয়ে আসছে। কোথাও কোথাও মাটির নিচ থেকে চালের বস্তা বের হচ্ছে। অথবা সরকার এগুলোকে কঠোরহাতে দমন করার কথা ছিলো। ঠিক এই মূহুর্তে দরকার খুব নির্মম ও কঠোর বিচার।
আরেকটা ভয়াবহ ব্যাপার হলো করোনায় আক্রান্ত হয়ে অনেকে লুকিয়ে রাখছেন নিজেদের। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর এ থেকে আক্রান্তের পরিমাণ দিনদিন আরও বৃদ্ধি হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে একজন ডাক্তার পর্যন্ত এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছেন। সকল উপসর্গ থাকার পরেও তিনি পরীক্ষাতো করাননি বরং পজেটিভ হওয়ার পরও কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অথচ তিনি পুরো সময় চেম্বার করেছেন, সকল সামাজিক অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন বলে তার একজন পড়শী জানিয়েছেন।
আজ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তালিকা ১০০ পার হলো। এই তালিকায় আমার পরিচিত মানুষের নামও যুক্ত হয়েছে। আক্রান্ত প্রায় তিন হাজার মানুষ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত। আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। পরীক্ষার মাত্রাও বাড়ছে। তবে মৃত্যুর মিছিলের সাথে সুস্থ হওয়ার মিছিল পেরে উঠছেনা। এই করোনাকালে আমরা প্রতিদিন দেখছি মানুষের তীব্র ক্ষুধা, অভাব আর দিশেহারা অবস্থা। সেদিন একটা ফোন পেলাম। নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবারে ৬ জন মানুষ খানেওয়ালা। কয়েকদিন হলো তাদের ভয়াবহ খাদ্য সংকট। কাউকে বলতেও পারছেন না, আবার সইতেও পারছেনা। আমাদের পরিচিতকে জানালে আমরা সামান্য খাবার তাকে পৌঁছে দিতে পেরেছি। এক বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেলাম একটা বেদে বহর আটকে আছে বসিলার পরে একটা জায়গায়। ১২ জন মানুষ অভুক্ত। আমরা যোগাযোগ করলাম। তারা জানালো, “এমনিতেই সমাজে আমাদের জায়গা নেই। তারপর এসময়ে কাজ না থাকায় না খাওয়ার জো। গ্রামের এক মেম্বার কিছু আটা দিয়েছিলো সেটা দিয়ে দুদিন চলেছে।” সেদিন শুনলাম সাভার ও আশপাশের অসংখ্য ভাসমান যৌনকর্মী ও তাদের পরিবারগুলো অভূক্ত। আমরা তাদের বেশকিছু পরিবার সহযোগিতা করেছি এরই মধ্যে। কিছু হকার অভূক্ত, কয়েকজন গৃহকর্মী, কিছু শিক্ষার্থী, একজন অসহায় মা, একজন বাইকার, একজন দিনমজুর, একজন বিধবা এমন কত কত মানুষ ও তাদের চাওয়া আমাদের প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে, কিছু করতেও হচ্ছে। তবে আমরা সবার পাশে দাঁড়াতে পারছি না।
তবে আমরা চাই। আমরা এটাও জানি এ দায়িত্বটা রাষ্ট্রের, সরকারের। তারা যদি আন্তরিকভাবে চায় তবেই সবার মুখে খাবার দেয়া সম্ভব। কিন্তু একজন নাগরিক হিসেবে আমরা কি বসে থাকতে পারি ? তাইতো আমাদের এই সামান্য প্রয়াস। এজন্যই আমরা “চাল, ডাল, আলু। বাঁচার জন্য। ৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ” একটা ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলাম ঢাকা শহরের নিন্ম আয়ের মানুষদের জন্য। আজ পর্যন্ত ৪ শতাধিক মানুষকে আমাদের খাদ্য সহযোগিতা পৌঁছাতে পেরেছি। ৫ কেজি চাল, ২কেজি আলু, হাফ কেজি পেয়াজ, ডাল, তেল, একটি সাবান ও এক প্যাকেট লবণ এগুলোই আমাদের পরিবার প্রতি খাদ্য সহযোগিতা। গত কয়েকদিন হলো আমরা দেখছি আমাদের সহযোগিতার মাত্রা কমে এসেছে। এর কারণ আর কিছু নয়, মধ্যবিত্তের টাকায় টান পড়েছে আর তারা হয়তো ভয় পাচ্ছে আগামীতে কি হতে যাচ্ছে তা ভেবে। তবুও আমাদের এই উদ্যোগ আমরা থামাতে চাই না। আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে চাই।
আমরা চাই একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক। যে পৃথিবী হবে মানবিক। যুদ্ধ ভুলে পৃথিবীতে চাষ হোক ভালবাসার। একই ভাবে আমরা একটা সাম্যের দেশ ও সমাজ দেখতে চাই। যেদেশে আজকের মতো মানুষকে ক্ষুধার জন্য কষ্ট করতে হবেনা। মানুষ তার মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে শিখবে। কিন্তু এমন একটা পৃথিবী, দেশ ও সমাজ কি এমনি এমনি সৃষ্টি হবে? কখনই না।
আজকে বাংলাদেশের এই সংকটের মাঝে দাঁড়িয়ে কাজ করছে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে সারা দেশে। নিরবে নিভৃতে, কেউ জানেনা। আমার গ্রামের ছেলে মোস্তফা আর প্রবাসী পারভেজ নিরবে মানুষকে সহযোগিতা করছে, কেউ সেটা জানেকি? এক পাগল ছেলে আছে মনির সে এ্যাজমার রুগি, হাই প্রেসার, ঠান্ডার ধাচ, সে বলে আমি হলো করোনা আসল খাবার। সেই ছেলে বাড়ী ছেড়েছে প্রতিদিন ১০০০ মানুষের জন্য তার কারখানায় খিচুড়ি ডিম রান্না হয়, সে নিজেও সেটাই খায়। সে বলে, “ভাই দরকার হলে ‘নাই হইয়া যাব’ কিন্তু মানুষের সাথেই থাকা লাগবো”। কি পাগল ছেলে! ছোট্ট মেয়ে মৌরি সারাদিন তার মাথায় কিভাবে আর একজন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া যাবে। সাইফতো কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে গেলো। তবুও কাজ থামছে না। দিপক মোটরসাইকেলে খাবার নিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘুরছে। কলেজ ছাত্র শুভ নিজে খিচুড়ি রান্না করে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষারীদের বিলি করে আর প্রতিদিন জিজ্ঞেস করবে, “ভাই পরের দিন কোথায় খাদ্য বিতরণ করবো?”
আমি যাদের নাম বলছি তারা সবাই সংগঠনের নয়, অনেকেই ব্যক্তিগতভাবেই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে নানা সংগঠন তা তাদের কর্মকান্ড। কিন্তু এইযে হাজারো তাজা প্রাণ ভয়হীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের এই যুথবদ্ধ শক্তিকে কি আমরা কাজে লাগাতে পারবো, রাষ্ট্র পারবে? আমরা কি তাদেরকে স্যালুট জানাচ্ছি? সারাদেশেই এরা লড়াই করছে দারুণ ভাবে, স্পর্ধার সাথে। আমরা চাই এই সকল তাজ প্রাণ আগামীর বাংলাদেশ ও একটি ন্যায়ভিত্তিক ন্যায্যতার সমাজ প্রতিষ্ঠায় দারুণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা জানি আমরা অনেককেই হারাবো, পরিবারে, সমাজে, সকলক্ষেত্রেই। কিন্তু একটা সুন্দর আগামীর জন্য আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকুক।