করোনায় বিপাকে আছে সুন্দরবন নির্ভর বনজীবী মৌয়ালিরা
শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
প্রতিবছর বাংলা ১৮ চৈত্র ও ইংরেজি ১লা এপ্রিল থেকে শুরু হয় মধু সংগ্রহের মৌসুম। এই সময়ে উপকুলীয়াঞ্চলে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মৌয়ালি জনগোষ্ঠী স্থানীয় এলাকার স্ব স্ব ফরেস্ট স্টেশন থেকে পাশ কেটে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করেন। প্রতিবছর এই মৌয়ালিরা সুন্দরবন থেকে হাজার হাজার মন মধু ও মোম সংগ্রহ করে। আর মধু সংগ্রহের কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ন একটি কাজ। বনের মধ্যে সারাদিন গাছের দিকে তাকিয়ে মধু খোঁজ করতে হয়। কখন কোন সময় অজান্তে বাঘের আক্রমনের শিকার হতে হবে তাও তাদের জানা নেই। অন্যদিকে জলদস্যু এবং এলাকায় বড় বড় মহাজননেরা তাদের নিঃশেষ করার পায়তারায় মত্ত থাকে। তার পরেও তারা এই পেশাটিকে ছেড়ে দেয় না। কারণ তারা মনে করে এটি আমাদের পুর্ব পুরুষের কাজ। এটি যেনো বংশপরম্পারায় চলে আসতেছে, এটি যেনো তাদের রক্তে মিশে গেছে। তারা সুন্দরবনকে তাদের মা বলেন কারণ, এখান থেকে তাদের আয় রোজগার, তাদের বাঁচা মরা সব কিছু ।এছাড়াও সময় উপযোগী সময়ে তারা সুন্দরবন থেকে নানান ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য। আর তার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ মধু অন্যতম। প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করে এ মৌয়ালিরা নিজেদের আয়ের অন্যতম উপায় মনে করেন। তাছাড়া সুন্দরবন থেকে যে মধু উৎপাদন হয় তা স্বাদে গুনে ভরপুর। আর এ মধু আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু বর্তমান সময়ে যে মহামারী করোনা দুর্যোগ এসে হাজির হয়েছে এটা মৌয়ালিদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যারা মধু সংগ্রহের কাজটার সাথে বেশি জড়িত সেই মৌয়ালিদের। কারণ এই করোনা দুর্যোগের কারণে উপকুলীয় সুন্দরবন নির্ভর জনগোষ্ঠী তারা তাদের নিজেদের পেশায নিয়োজিত থাকতে পারছে না। যারা মাছও কাঁকড়া সংগ্রহের কাজ করতো তারা এখন সেটা করতে পারছেনা। যদিও বনজীবীরা সবাই সব কাজে অভ্যস্ত কিন্তু কেউ কোন কাজ বেশি করে আবার বেউ কোন কাজ কম করতো। যেমন মধু সংগ্রহের কাজটা খুবই কম লোকে করতো। আবার মাছ ও কাঁকড়া ধরার কাজটা বেশি লোকে করতো। কিন্তু চারিদিকে যখন করোনার এই বিপর্য়য় কাটিয়ে ওঠার জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে দেশে। তার মধ্যে লকডাউন অন্যতম।আর এ লকডাউনের কারণে হাট বাজারে মানুষ কম। রাস্তা ঘাটে গাড়ি চলছে না, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সব রকম যাতায়াত এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে বনজীবীরা তাদের সংগৃহীত মাছ ও কাঁকড়া বিক্রি করতে পারছেনা। আর যা বিক্রি হচ্ছে তাতে নিজেদের খরচও উঠছে না। যেখানে আগে ১ কেজি কাঁকড়া ৪০০-৬০০ টাকায় বিক্রি হতো; তা এখন ৭০-১০০ টাকা।এছাড়াও বনজীবীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে। তারা মনে করতে শুরু করলো যেহেতু করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। আর আমাদের এই কাঁকড়াও বেশি রপ্তানি তো হয় বিদেশে। তারাই এখন বিপদে মানে এই কাঁকড়া আর বাহিরে যাবেনা। যার কারণে যারা কাঁকড়া সংগ্রহের কাজের সাথে যুক্ত ছিলো তারা এখন কাঁকড়া সংগ্রহ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আর এতে করে মৌয়ালিরা বেশি বিপাকের মধ্যে পড়তে চলেছে বলে তারা জানান।
এবিষয়ে উপকুলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মৌয়ালিদের সাথে স্বাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের বিপাকে পড়ার কথা জানা যায়। যখন থেকে করোনার কারণে এলাকায় কাঁকড়ার বাজার মুল্য কমে যাচ্ছে। কাঁকড়া এলাকার বাহিরে কোথাও বিক্রি হচ্ছে না। মাছের রেনু পোনা ধরতে পারছেনা। সাদা মাছের মুল্য কম। মানুষ বাহিরে যেতে পারছেনা বাহিরে কোন কাজও করতে পারছেনা। তখনই মানুষ কাঁকড়া ধরার কাজ বাদ দিয়ে এবং অন্য কোন কাজ না পেয়ে বর্তমান সময়ে যে মধুর মৌসুম চলছে সেই দিকে সবাই বেশি ঝুঁকে পড়েছে। যারা আগে কোন সময় মধু সংগ্রহ করতে যায়নি তারাও এবার মধু সংগ্রহ করতে গেছে। এতে করে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মানুষ ও নৌকার সংখ্যা বেড়েছে। যাতে করে একদিকে অনেক বেশি মানুষ অন্য দিকে বৃষ্টি না হওয়াতে ফুল বেশি না ফোঁটার কারণে সুন্দরবনের মধুর পরিমাণও কমে গেছে। যেখানে এক একটি দলে আগে ১৫ দিনের পাশে প্রায় ৭ -৮ মন মধু পাওয়া যেতো সেখানে ৮ দিনে প্রায় ২ মন মধু পাওয়া গেছে। এতে করে মৌয়ালিদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দাতিনাখালী গ্রামের বনজীবী মৌয়ালি ছবেদ আলী গাজী বলেন যে, এবছর মধু সংগ্রহ করতে প্রচুর মানুষ বনে গেছে যা একেবারে অবিশ্বাস্য ঘটনা। যেখানে প্রতি বছর আমাদের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ থেকে ৬০-৭০টি নৌকা আর আমাদের দাতিনাখালী থেকে ৬-৭ টি নৌকা যেতো। আর সেখানে এবছর বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ থেকে ১২০ টি নৌকা ও আমাদের গ্রাম থেকে ২০টি নৌকা গেছে। আর এরা সব কাঁকাড়া ধরার নৌকা। যারা শুধু কাঁকাড় ধরতো এবং কাঁকড়া ধরতে যেয়ে সামান্য পরিমানে মধু নিয়ে আসতো তারা এখন সবাই মধুর পাশ করে গেছে। আর এ শুধু মাত্র করোনার কারণে। করোনায় যখন একে একে সব কিছু বন্ধ হওয়া শুরু করেছে। মাছের বাজার, কাকড়া সব অচল হয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের বনজীবীদের পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা যারা প্রকৃত মৌয়ালি তারা অনেক কম মধু পেয়েছি বা পাচ্ছি। বনের মধ্যে মধুর সংকট দেখে আমরা ৭ দিন যেয়ে ফিরে এসেছি। একদিকে মধু কম অন্য দিকে অনেক বেশি মানুষ। আবার কোন কিছুর বাজার মুল্যও ভালো না।
তিনি আরো বলেন, এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে যদিও সুন্দরবন থেকে যা মধু সংগ্রহ করেছি তাতেও আরো এক বিপদে এসে হাজির। কারণ এলাকায় যেসব মধুর পাটি আছে তারা মধুর সঠিক দাম দিচ্ছেনা। এদিকে যখন এলাকার বাহিরের কোন পাটি আসতে পারছে না। তখন তারা যেনো আরো পেয়ে বসেছে। চারিদিকে লকডাউন কাজ কর্মও করতে পারছিনা। সংসারও তো চালাতে হবে- তাই বাধ্য হয়ে মধু কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী আমাদের এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে। তারা আমাদের কাছ থেকে মধু কম দামে কিনে পরে বেশি দামে বিক্রি করার চিন্তা ভাবনা করছে। যে খলিসা ফুলের প্রথম মধু আমরা ২৪-২৮ হাজার টাকায মন বিক্রি করতাম সে মধু ১৬-১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে করে একদিকে মধুর পরিমাণ কম আবার বাজার মুল্যও অনেক কম। এতে আমাদের মৌয়ালিদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। এখন যেনো করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের চেয়ে তিন বেলা খাবার খেয়ে জীবন বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এরকম চলতে থাকলে আমাদের পরিণতি যে কি হবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেনা।
করোনার এই ক্লান্তিকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ অর্থনৈতিক নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হওযার আশঙ্কা প্রকট আকারে ধারণ করতে চলেছে। এর শেষ যে কি এবং কিভাবে তা শেষ হবে তা কেউ বলতে পারেনা। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেমন মৃত্যু ও আক্রান্তের হার বাড়ছে। সাথে বাড়ছে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ভোগান্তী ও খাদ্য সংকট। বিশেষ করে পেশাজীরা আছে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে। তাদের মধ্যে বনজীবীরাই অন্যতম। কারণ তারা পুরোপুরি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরনের মধ্যে তাদের জীবন জবিকা চলে। এই করোনা দুর্য়োগের মধ্যে তারা নিজেদের শ্রম দিয়ে চলেছে। তার পরেও তাদের সেই শ্রম ও উপার্জিত পণ্যের সঠিক মুল্য পাচ্ছেনা। তারা মনে করে যে, কোন একদিনই হয়তোবা এই দুর্য়োগ থাকবেনা। আমাদের তো টিকে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে কোন ভাবে আমাদেরকে যদি কোন সহায়তা করা হতো সেটা সরকারী-বেসরকারী যে কোন প্রতিষ্ঠানই করতে পারে। আমাদের মধুগুলো আমানত হিসাবে রেখে দিয়ে কোন সহায়তা। এছাড়াও ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে কোন ঋণের ব্যবস্থা করা। সাথে এই দুর্য়োগকালীন সময়ে কোন ভাতার মাধ্যমে আমাদের টিকে থাকার অবলম্বনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা। সকল দল বল নির্বিশেষে সকলকেই একত্রিত হযে এবং সামর্থ অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ সুন্দরবন নির্ভরশীল বনজীবী মৌয়লিদের বিপাকে পড়ার হাত খেকে উত্তোরণের উপায় খোঁজা জরুরী হয়ে পড়েছে।