এবারে শীতে কুয়াশা কম, বরেন্দ্রের রবিশস্য পড়ছে সেচ হুমকিতে
বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
হেমন্তকালে বীজ বুনে যে ফসল বসন্তকালে ঘরে তোলা হয় তাই রবিশস্য। এই কথাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই হেমন্তকালের মাটিতে জো থাকে এবং শীতকালজুড়ে কুয়াশার আর্শীবাদে রবিশস্য সেচবিহীনভাবে ঘরে তোলা যায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে শীতকালীন তাপমাত্রার তারতম্য, শীতের দীর্ঘতা বিবেচনা করে বিনা সেচের রবিশস্যতেও সেচের প্রয়োজন হয়ে পরছে। চলতি বছরের এমনই সমস্যার শিকার হয়েছেন উচ্চ বরেন্দ্র হিসেবে পরিচিত গোদাগাড়ি, তানোর এবং নাচোল এলাকার কৃষকরা। এবার চলতি রবি মৌসুমে জমি ভেদে তিন থেকে চারটি সেচ দিতে বাধ্য হয়েছে রবিশস্য চাষীরা। যার ফলে উৎপাদন খরচ কম রবিশস্যতেও এবার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র এলাকা। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১,৬০,০০০ হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, নাচোল, গোমস্থাপুর এবং নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহারের আবহাওয়া বেশি রুক্ষ এগুলোকে ‘ঠা ঠা বরেন্দ্র’ বলা হয়। এই অঞ্চলগুলোতে যে কোন ফসল চাষের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় সেচ কাজের। বৃষ্টি নির্ভর আমন ব্যতিত সকল ফসল যেমন আলু, বোরো ধান,বিভিন্ন মৌসুমী সবজি চাষের ক্ষেত্রেই সেচ একটি অপরিহার্য উপাদান। আবার কোন কোন বছর বৃষ্টি পাতের তারতম্যর কারণেও আমনে বাড়তি সেচের প্রয়োজন হয়। সেদিক থেকে রবিশস্য চাষের ক্ষেত্রে চাষ পদ্ধতি, সময়কাল, সেচ প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে দেখা যায়, এই ফসলগুলো প্রায় সেচ বিহীনভাবেই ঘরে তোলা যায়। বা কোন কোন বছর জমি ভেদে এক থেকে দুইটি সেচ দিয়েই চাষ সম্পন্ন হয়।
কিন্তু এ বছর শীতকালের শুরু থেকেই তেমনভাবে কুয়াশা/শিশিরের দেখা পাওয়া যায়নি। যার প্রভাব এর মধ্যেই পেতে শুরু করেছে তানোর, গোদাগাড়ি, নাচোল অঞ্চলের কৃষকরা। এখানে উল্লেখ যে, শিশির পানি দিয়ে রবি শস্যের সেচ চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাঁধাইর ইউনিয়নের ঝিনাখোর গ্রামের কৃষক মো. হাছেন আলী (৪৫) বলেন, ‘আমরা রবি মৌসুমে এমনিতেই তেমন ফসল চাষাবাদ করতে পারিনা। মাটির গঠন ও পানির স্তর অনেক নিচে থাকার কারণে অনেক জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। কিছু জমিতে রবিশস্য চাষ করা সম্ভব হয়। কিন্তু এ বছর শীতে কুয়া (শিশির) না থাকার কারণে আমার চাষকৃত ৬ বিঘা মসুর, ৩ বিঘা ছোলা, ২ বিঘা গম থেকে আশানুরূপ ফলন পাব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাশাপাশি গতবার গমে একটি সেচ দিলেও এ বছর এর মধ্যই তিনটি সেচ দেওয়া হয়ে গেছে যার কারণে কম খরচের রবি শস্যতেও এবার উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পরে যাচ্ছে। পাশাপাশি শিশিরের পানি না থাকায় মসুর, ছোলা, মটর, গমে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগ। যার কারণে কৃষককে বাড়তি কীটনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে যা পরিবেশশের জন্য হুমকি স্বরূপ।’
এ বিষয়ে চাঁপাই-নবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার বরেন্দ্র গ্রামের কৃষক মো. হাসান আলী (৪৮) বলেন, ‘কুয়াশা (শিশির) না পড়ার কারণে তো সেচ খরচ বেড়েছেই মাটিতে রস না থাকার কারণে মসুর, মটরের গাছগুলো দূর্বল হয়ে পড়েছে। যার জন্য বিভিন্ন পোকার আক্রমণ ঘটছে সে জন্য জমি ভেদে তিন থেকে চারবার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়েছে। অন্যবারের তুলনায় যা এক হাজার টাকা বেশি। কোন কোন কৃষক আবার রবিশস্য ভেঙ্গে দিয়ে বোর ধান চাষ করার চিন্তা করছেন।’ রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার বটতলী গ্রামের তেমনই একজন কৃষক মো. আকরাম আলী (৪৭) বলেন, ‘আমার দুই বিঘা জমিতে মসুরের চাষ করেছিলাম কিন্তু দুইবার সেচ, কীটনাশক স্প্রে ও সার প্রয়োগ করেও তেমন কিছু হচ্ছিল না তাই আমি দুই বিঘা জমিতেই মসুরগুলো ভেঙ্গে দিয়ে বোরো ধান চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্য বছরে রবিশস্যতে এক থেকে দুইটি সেচ দিয়েই আবাদ সম্পন্ন হলেও এবার তার উপয় নেই।’