হাওরের কৃষকরা পেল এলাকা উপযোগি ধানের জাত
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য বোরো ২০১৯ মৌসুমটি হল দূর্যোগের মৌসুম। হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান চাষ করতে গিয়ে কৃষকরা অধিকাংশ মৌসুমেই ক্ষতির সন্মূখীন হয়। এক মৌসুমে বাম্পার ফলন হলে পরের মৌসুমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর এটিই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে হাওরের কৃষিতে। বোরো ২০১৭ সালে হাওরের সমস্ত জমি আগাম বন্যায় তলিয়ে ফলন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু বোরো ২০১৮ মৌসুমে কৃষকরা বাম্পার ফলন ঘরে তোলে। এক মৌসুম যেতেই চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকরা আবার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অজ্ঞাত রোগে। বিশেষভাবে ব্রি-২৮ ধান চাষ করে কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই কৃষকদের অন্যতম দাবি এখন হাওরাঞ্চলের জমির জন্য উপযোগি ধানের জাত, যে জাত আগাম, ভালো ফলন, রোগবালাই প্রতিরোধী ও খরা সহনশীল। কিন্তু ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধান ছাড়া হাওরে তেমন কোন ধানের জাত নেই। তাই হাওরের কৃষকরা উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে হাওরের জন্য উপযোগি ধানের জাত খুঁজে বেড়ায়।
এলাকা উপযোগি ধানের জাত খোঁজার ধারাবাহিকতায় ৬ এপ্রিল ২০১৯ রোজ সোমবার হাওরের ৬ জন কৃষক রামেশ্বরপুর গ্রামে বারসিক এর সহযোগিতায় বোরো ২০১৯ মৌসুমে ৫০টি ধানের জাত নিয়ে কৃষক নেতৃত্বে পরিচালিত এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচন গবেষণা কার্যক্রমের মাঠ দিবসে অংশগ্রহণ করেন। হাওরাঞ্চল মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ও মদন সদর উপজেলার ৬ জন কৃষক এবং নেত্রকোনা সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর ও গাছগড়িয়া গ্রামের ৩ জন কৃষকসহ মোট ১৬ জন কৃষক (নারী-১) অংশগ্রহণ করেন।
অংশগ্রহণকারী কৃষকরা সরেজমিনে গবেষণা প্লট পরিদর্শন করে গবেষণাধীন ধানের জাতগুলো বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যাচাই-বাছাই করেন। সম্পূর্ণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত উপায়ে গবেষণাধীন জাতগুলোর পর্যবেক্ষণ করে হাওরাঞ্চলের তিনজন কৃষক ব্রি-২৮ এর বিকল্প হিসেবে হাওরের জন্য উপযোগি হবে এমন আগাম, ফলন ভালো ও রোগবালাই প্রতিরোধী তিনটি ধানের জাত এবং একজন কৃষক (বিশ্বনাথপুর) সমতল জমি উপযোগি এবং ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। কৃষকদের নির্বাচিত ধানের জাতগুলো হল- কেচকি, আইজং, M-171 ও DS-1। মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারী হাওরের কৃষকরা তাদের নির্বাচিত ধান কেটে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
এই প্রসঙ্গে হাওরের কৃষক সবুজ মিয়া ও মাসুদ রানা বলেন, ‘বারসিক’র প্লটে যেহেতু কোন ধরণের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই মোটামুটি ভালো ফলন হয়েছে এবং রোগবালাইও হয়নি, দানার সংখ্যা বেশি, শীষ ভালো ও আগাম হয়েছে তাই হাওরের জমিতে রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করলে আরও ভালো হবে, তাই আমরা কেচকি, আইজং ও M-171 জাতগুলো আগামী মৌসুমে চাষ করার জন্য নির্বাচন করেছি এবং এই ধানের বীজগুলো নিয়ে যাচ্ছি।’ সমতল এলাকার কৃষক আব্দুল কাদির বলেন,‘বেগুনী পাতা ধান দেখে আমার ভালো লেগেছে। এ জাতের ধানের চালে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন আছে শুনেছি। তাই আমি বেগুনী পাতা ও DS-1 জাতটি বাছাই করেছি আগামী আমন ও বোরো মৌসুমে চাষ করার জন্য।’
কৃষক মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছেন। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনরূপ উপকরণ ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল চাষের কৌশল ও গুরুত্ব সম্পর্কে কৃষকরা জানতে পেরেছেন। হাওরের কৃষকরা আগামী আমন ও বোরো মৌসুমে দু’টি করে (অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি এবং এক ফসলী জমি) কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জমির ধরণ অনুযায়ী (হাওর, সমতল ও পাহাড়ী) এলাকা উপযোগি ধানসহ বিভিন্ন শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে প্রায়োগিক গবেষণা স্থাপন ও পরিচালনায় কৃষকদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে তথ্য, পরামর্শ ও উপকরণ সহযোগিতা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কৃষকদের সম্পর্ক তৈরিতে সহযোগিতা করে আসছে। বারসিক বিশ্বাস করে কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি হলে কৃষকদের লোকায়ত জ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ে কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। কৃষকরা তাদের দক্ষতা দিয়ে চাহিদানুযায়ী জাত নির্বাচন ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে সক্ষম হবে। কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে এবং কৃষির রাসায়নিক উপকরণের ক্ষতিকর দিকগুলো ও ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হলে জৈব উপায়ে শস্য চাষাবাদ বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষসহ সকল প্রাণীকূলের নিরাপদ খাদ্য সুনিশ্চিত হবে।