বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় সবুজের সমারহ
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
ভৌগলিক ও কৃষিপ্রতিবেশগত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লবণাক্ততা হিসাবে পরিচিতি। এলাকার সুপেয় পানির উৎস খাল, ডোবা, নালা ও পুকুর যেখানে বর্ষার মিষ্টি পানি সংরক্ষিত করে রাখা হয়। কিন্তু এই এলাকা সমুদ্রকূলবর্তী হওযাতে এখানে যেন সব সময় নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ একাকার হয়ে এখানকার সংরক্ষিত মিষ্টি পানিকে লবণাক্ততায় রূপান্তুরিত হচ্ছে। যার কারণে উপকূলীয় এলাকায় ফসল ফলাতে কৃষকদের নানান ধরনের উদ্যোগ ও কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আর শত উদ্যোগ ও কৌশল অবলম্বন করেও কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় বছরব্যাপী ফসল চাষাবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠেনা।
বর্ষা মৌসুম বাদে অন্য মৌসুমে কিন্তু অধিকাংশ জমি পড়ে থাকে যেখানে লবণাক্ততার কারণে কোন কিছু উৎপাদন করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় এলাকার কৃষকেরা তাদের জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কারণ এই সময়ে চিংড়ি ঘের, পুকরের পানি, বিলের পানি, খালের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ কমে যায়। এসময়ে যার যতটুকু জায়গা আছে সেখানে নানান ধরনের ফসল চাষবাদ করার চেষ্টা করেন। এই সময় যার কোন পুকুর নেই তিনিও কিন্তু বৃষ্টির পানি দিযে সবজি চাষের চেষ্টা করেন।
চলতি মৌসুমে মাঠ পর্যবেক্ষণে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন্ ইউনিয়নের স্থানীয় কৃষক-কৃষাণীদের সাথে কথা হলে তারা বর্তমান মৌসুমে ফসল চাষাবাদের সফলতার কথা তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে শ্যামনগর সদর ইউনিযনের সুন্দরবন গুচ্ছ গ্রামের প্রবীণ কৃষক আব্দুল গনি বলেন, ‘আমরা এই চুনা নদীর চরে সেই এরশাদ সাহেবের আমল থেকে ৪০টি পরিবার বসবাস করি। আমাদের চারিপাশে লবণ পানি। এখানে সব সময সবকিছু উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তার পরে আমরা সবাই কম বেশি চেষ্টা করি। কিন্তু বর্ষা মৌসুমের সবজি ফসল দেখলে মনে একটু আনন্দ পাই। চারিদিকে যেন সবুজ আর সবুজ। কারণ এই সময় যেকোন সবজি আমরা চাষাবাদ করতে পারি। এখন আমাদের ক্ষেতে বর্ষাকালীন সব রকমের সবজি আছে। ঝাল থেকে শুরু করে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শসা, বেগুন, বরবাটি, ঝিঙা, তরুল, ঢেড়স, পুইশাক, লালশাক, ডাটাশাক, উচ্ছেসহ নানা ধরনের সবজি। এই সময়ে আমাদের তেল মসলা ছাড়া আর অন্য কোন সবজি তেমন একটা কেনা লাগেনা। এ সবজি সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে আমরা বাজারে বিক্রি করতে পারছি।”
অন্যদিকে গুমানতলী গ্রামের মর্জিনা বেগম বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম যেন আমাদের বাড়ি সবুজ আর সবুজ থাকে। এসময় বর্ষার মিষ্টি পানি থাকায আমরা সবকিছু করতে পারি। তাই এসময় আমরা আমাদের কোন জায়গা ফেলাই রাখিনা। যতটুকু জায়গা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করি। ঘেরের রাস্তা, পুকুর পাড়, ক্ষেতে, ঘরের সামনে পিছনে সব জায়গায় সবজি লাগানো হয়। আমার ৬ জনের পরিবারে মাসে প্রায় ১৮০০ টাকা করে সবজি কিনতে হতো এখন তা লাগছে না। সাথে সবজিও বিক্রি করতে পারছি। অন্য মৌসুমে শুধুমাত্র শীতকালে একটু লালশাক, পালনশাক ও পুইশাক হয়।’ মর্জিনা বেগম আরো বলেন যে, ‘বর্তমান যে করোনা সময় এসময় বাইরের কাজ তেমন একটা হচ্ছে না। তাই বাড়িতে সবজি চাষ করে কাজের ঘাটতি পুরনের চেষ্টা করছি। এতে করে এ করোনাকালীন সময়ে সংসারের আয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছি। আমাদের মিষ্টি পানির সুব্যবস্থা থাকলে হযতোবা আমরা সারাবছর ফসল উৎপাদন করতে পারতাম।”
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি থাকার কারণে সব সময় সবজি ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। যার কারণে মিষ্টি পানির সুব্যবস্থা না করতে পারায় অধিকাংশ পরিবার বিশেষ করে যারা নদীকূলবর্তী, চিংড়ি ঘেরে পাশে ভিটা, পুকুরের পানি লবণ হওয়াসহ ওয়াপরাস্তা থেকে চুয়ে চুয়ে লবণ পানি প্রবেশের কারণে সবজি চাষ ব্যাহত হয়। কিন্তু বর্ষামৌসুমে প্রায় পরিবারে কম বেশি সবজি চাষ করে সংসারের খাদ্য ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখে।