গ্রামীণ নারীর মর্যাদা ও কাজের স্বীকৃতি নিশ্চিত হোক
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
‘গ্রামীণ নারী ও কন্যারাই পারে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রতিরোধ তৈরি করতে’-এ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে গতকাল বারসিক’র উদ্যোগে এবং জেলা নারী উন্নয়ন কমিটি, মানিকগঞ্জ এর আয়োজনে পালিত হয় বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। দিবসকে কেন্দ্র করে স্যাক কার্যালয়ে জেলা নারী উন্নয়ক কমিটির প্রতিনিধি ও নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা নারী উন্নয়ন কমিটির সভাপতি শামীমা চায়না এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বারসিক’র মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী। দিবসকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বারসিক’র প্রোগ্রাম অফিসার রাশেদা আক্তার।
আলোচনায় শামীমা চায়না তার বক্তব্যে বলেন, ‘নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি বাইরেও অনেক কাজ করতে পারেন যদি তাঁর ইচ্ছে থাকে। আমি নিজেই তার উদাহরণ। আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ২৪ বছর আগে। আমি নিজেও বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছি। সংসারের কাজ করার পর আজ আমি বাইরের জগতে আমার নিজের একটি পরিচয় তৈরি করতে পেরেছি। তবে এই পরিচয় গড়ে তোলার পথও খুব সহজ সরল ছিল না। অনেক বাধা অতিক্রম করেই আমাকে আজকের এখানে আসতে হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমি জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হতে পেরেছি, জেলা নারী উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হতে পেরেছি। একসময় যারা আমাকে ভাবী বলতো আজ তারা আমাকে আপা বলে। এক সময় আমার পরিচয় ছিল আজিজ মোল্লার বউ। এখন আমার পরিচয় আমি শামীমা চায়না। আপনাদেরও কিছু করার আগ্রহ থাকতে হবে, ইচ্ছে থাকতে হবে। যখন টাকা আয় করে সংসারে দিবেন তখন আপনারম স্বামী, সন্তান আমাকে মর্যাদা দিবে। তাই আপনারা যার যার মত করে যে কাজটি পারেন সেটা দিয়েই শুরু করেন। একদিন দেখবেন আপনিও অন্য ১০ জনের ১ জন হতে পেরেছেন।’
উদ্যোক্তা মোছা: মুক্তা আক্তার বলেন, ‘নারীরা ইচ্ছে করলেই ঘরে বসে আয় করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন ইচ্ছেশক্তি এবং কাজ করার মানসিকতা। আপনারা যারা এখানে আছেন তারা যে কাজটা পারেন সেটাই যদি করতে চান আমি আপনাদের সহযোগিতা করবো। কারো যদি কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দরকার হয় আমরা প্রশিক্ষণ দেব। আপনারা জৈব উপায়ে শাকসবজি চাষ করতে পারেন। জৈবসার তৈরি করতে পারেন। হস্ত শিল্পের কাজ করতে পারেন। যে যা করতে চান আমরা আপনার কাজটাকে গুছিয়ে করার জন্য পরামর্শ দিব, সহযোগিতা করবো। আপনাদের উৎপাদিত পন্য আমরাই কিনে নেব। আপনারা যাতে ক্ষতির সম্মুখীণ না হন সেদিকে আমরা খেয়াল রাখবো।’
এডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ বলেন, ‘গ্রামীণ নারীরা ঘরের পাশাপাশি বাইরেও অনেক কাজ করছেন। নারীরা চাইলেই সব করতে পারেন। এজন্য নারীদের আগ্রহ থাকতে হবে। নারীরা অনেক কাজ করেন। সংসারের নানাবিধ কাজ তাঁরা করে থাকেন। যদিও নারীর কাজের সেভাবে কোন মূল্যায়ন নেই। গ্রামীণ নারীরা তাদের কাজের স্বীকৃতি পাক, মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক গ্রামীণ নারীর। বিশ^ গ্রামীণ নারী দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।’ আলোচনায় বক্তারা গ্রামীণ নারীর মর্যাদা ও কাজের স্বীকৃতির বিষয়টি তুলে ধরেন। গ্রামীণ নারীরা যাতে সংসারে কাজের পাশাপাশি ঘরে বসেই আয়বৃদ্ধিমূলক কাজ করতে পারে সেজন্য প্রত্যেক নারীকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠার আহবান জানানো হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে। গ্রামীণ সকল নারীই কৃষির সাথে জড়িত। এই গ্রামীণ নারীরা প্রতিনিয়ত কৃষিতে অবদান রেখে চলছে। গ্রামীণ নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে বীজ সংরক্ষণ, বীজ বাছাই, সবজি চাষ, রোগ বালাই দমনের বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার,বাড়ির সকল ধরণের গৃহস্থালী কাজ, গবাদি প্রাণির যতœ ও দেখাশোনা করা, নিরাপদ খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা, নিরাপদ খাদ্য সংগ্রহ, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সবজি সংগ্রহ, জৈবসার উৎপাদন ও পরিচর্যা করা, ঔষধী গুণ সম্পন্ন গাছ লাগানো, ও পরিচর্যা করা, পানীয় জল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করাসহ অন্যান্য কাজ সমূহ হয়ে থাকে। গ্রামীণ নারীরা এই সকল কাজ করে থাকে বিনামূল্যে বা কোন ধরণের পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়াই। তাদের এই অবদান পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব আছে তবে মর্যাদা নেই। কারণ এই ধরণের কাজ কে কোন কাজ হিসেবে ধরাই হয় না, যেহেতু এই ধরণের কাজ করার জন্য পরিবারের কোন অর্থ ব্যয় হয়না । গ্রামীণ নারী ও কন্যা এই ধরণের কাজ বংশপরম্পরায় ও অভিজ্ঞতার আলোকে শিখে থাকেন। গ্রামীণ নারী ও কন্যাদের অবহেলা, করুণার চোখে দেখা হয়। ১৮ বছরের আগেই গ্রামীণ নারী বিয়ের শিকার হয়। শহরের নারীদের দ্বিগুণ গ্রামীণ নারী বাল্য বিবাহের শিকার হয়। গ্রামীণ নারীর মতামত, ইচ্ছা, পছন্দ, চিকিৎসা, শিক্ষার অধিকার অবদমন করা হয়। এত প্রান্তিকতার পরও গ্রামীণ নারীজলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষির পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে উঠানে, মাচায় সবজি চাষসহ অন্যান্য চর্চা করে থাকে। গ্রামীণ নারীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা চর্চার মাধ্যমে কৃষি হয় সমৃদ্ধ।