মালশিরা ধানে আশুজিয়ার কৃষকরা মাতোয়ারা
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
কৃষির বিষয়ে নতুন কোন তথ্য ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের দ্রুততম মাধ্যম হলো আমাদের দেশের কৃষক। কৃষি বিষয়ে কোন তথ্য ও প্রযুক্তি পেলেই কৃষকরা তাতে মগ্ন হয়ে যায়। কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া গ্রামের ‘সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন’র কৃষকরাও এর ব্যাতিক্রম নয়। এ সংগঠনের সভাপতি কৃষক আবুল কালাম। ২০১৫ সালের অগ্রহায়ণ মাসে আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামের ‘তুষাইপাড়ের কৃষক সংগঠন‘র এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনে পরিচালিত প্রায়োগিক গবেষণাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত কৃষক মাঠ দিবসে বারসিক’র আমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করেন কৃষক আবুল কালাম। তিনি আরও জানতে পারেন সংগঠন পরিচালিত গ্রামীণ বীজঘরে দুই শতাধিক স্থানীয় জাতের ধান বীজ সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি মাঠ দিবসে গবেষণা প্লটগুলো পরিদর্শন করে সেখান থেকে ১০টি স্থানীয় জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে ‘সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন‘র উদ্যোগে আমন ২০১৬ সালের আমন মৌসুমে এলাকা উপযোগি পছন্দের ধানের জাত নির্বাচনের জন্য একটি প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করে পছন্দের জাত নির্বাচনের জন্য ‘কৃষক মাঠ দিবস’ আয়োজন করা হলে অংশগ্রহণকারীরা গবেষণাধীন স্থানীয় জাতের ‘মালশিরা’ ধানটি এলাকার মাটি ও আবহাওয়ার জন্য উপযোগি হওয়ায় পছন্দ করেন। আমন ২০১৭ মৌসুমে চারজন কৃষক নিজের জমিতে অল্প পরিমাণে মালশিরা ধানের চাষ করে ভালো ফলন পায়। সংগঠনটির উদ্যোগে আমন ২০১৭ মৌসুমে পুনরায় মালশিরা ধানটি জাত গবেষণা কার্যক্রমে চাষ করেন। কৃষক মাঠ দিবসে মালশিরা ধানের জাতটি অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কৃষকেরা মালশিরা ধানের জাতটি সর্ম্পকে কৃষক আবুল কালামের নিকট থেকে জানতে চান। বিশেষভাবে মালশিরা ধানের উৎস কি এবং এর বীজ নেয়া যাবে কিনা? কৃষক মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১০জন কৃষক ভালো ফলন, ধান ছোট ও সুগন্ধি হওয়ায় ‘মালশিরা’ ধানটি পছন্দ করেন এবং ধানের বীজ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আমন ২০১৮ মৌসুমে কৃষক আবুল কালাম তার ১২০ শতাংশ জমিতে মালশিরা ধানের চাষ করেন। আবুল কালাম গ্রামের ৫জন কৃষককে মালশিরা ধানের বীজ দেন। পাঁচজন কৃষকরা বীজ দিয়ে তাদের তিন একর জমি চাষ করেন। আমন ২০১৮ মৌসুমে মালশিরা ধান চাষকে কেন্দ্র করে বড় করে গ্রামে কৃষক মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। মালশিরা ধান গাছের গড় উচ্চতা ১০৫ সে.মি. গাছ মাঝারী আকারের হওয়ায় হেলে পড়েনা, রোগ-বালাই সহনশীল, শীষের দৈর্ঘ্য ২৩ সে.মি, বীজতলা-কাটা পর্যন্ত মোট জীবনকাল ১৩৯ দিন, প্রতি শীষে পুষ্ট দানের সংখ্যা ২১৫টি এবং চিটার সংখ্যা গড়ে ১০টি, ধানের আকার মাঝারী চিকন, চাল সাদা বর্ণের ও সুগন্ধি।
মাঠ দিবসে কৃষকরা তাদের পছন্দ করা ধান কেটে মাড়াই করে এবং ফলন ওজন করে প্রতি ১০ শতাংশ জমিতে ১৮০-২০০ কেজি (বা ৪-৫ মন/কাঁচা মাপে) ফলন পেয়েছেন। চারটি গ্রামের ৮ জন কৃষক ৫ কেজি করে মোট ৪০ কেজি মালশিরা ধান বীজ সংগঠন থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যান আগামী আমন মৌসুমে জমিতে চাষ করার জন্য। আশুজিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক মালশিরা ধান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘মালশিরা ধানের ফলন অনেক ভালা, আগামীবছর অনেক কৃষক এই ধান চাষ করার আশা করছেন।’
চলতি আমন মৌসুমে (২০১৯ সালে) কৃষক আবুল কালাম ১২০ শতাংশ জমিতে এবং গ্রামের আরো ১০জন কৃষক তাদের ৪০০ শতাংশ জমিতে মালাশিরা ধান চাষ করেছেন। আশুজিয়া গ্রামে চলতি আমন মৌসুমে মোট ৫২০ শতাংশ জমিতে মালশিরা ধান চাষ করেছেন। চলতি মৌসুমেই মালশিরা ধানের ফলন এলাকার কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এলাকার সকলের মুখেই মালশিরা ধানের প্রশংসা শুনতে পাওয়া যায়। কৃষক আবুল কালাম আশুজিয়া ও নগুয়া দু’টি গ্রামের কমপক্ষে ৩০০টি পরিবারকে আধ কেজি করে মালশিরা ধানের বীজ বিতরণ করবেন বলে জানান। কেন্দুয়া উপজেলার ২টি ইউনিয়নের মোট ১০টি গ্রামের কৃষকরা মালশিরা ধানের চাষ করছেন বলে গ্রামের কৃষক সূত্রে জানা যায়।
কৃষক আব্দুল আজিজ মিয়া বলেন, ‘মালশিরা ধানের ফলন প্রতি কাঠা জমিতে (১ কাঠা=১০ শতাংশ) ৫ মণ, জমিতে কোন সার ও বিষ দিতে না হওয়ায় এলাকার কৃষকদের এ ধানের ব্যাপক চাহিদা।’ কৃষক আবুল কালাম মিয়া বলেন, ‘আমি চলতি আমন মৌসুমে ১০ মণ মালশিরা ধানের বীজ রাখব। নিজের গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছাড়াও আমি কেন্দুয়া উপজেলার কয়েকটা ইউনিয়নে এ ধান প্রচার করবো, যাতে সবাই এ ধান চাষকরে লাভবান হতে পারে। আমি চলতি মৌসুমে ১৩টি পোলাও এর ধান (সুগন্ধি) নিয়ে ছোট আকারে গবেষণা করেছি। গবেষণা থেকে আমি এলাকার কৃষকদের নিয়ে ফলাও করে মাঠ দিবস আয়োজন করে পছন্দের জাত বাছাই করবো।’
আশুজিয়া গ্রামসহ মালশিরা ধান সম্প্রসারিত গ্রামের কৃষকেরা আশা করছেন এ ধানটি আগামীতে কেন্দুয়া এলাকার সকল কৃষকদের মাধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকরা মালশিরা ধানের মত তাদের চাহিদানুযায়ী ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম বলে কৃষকরা মনে করেন।