সহজে ধানের বীজতলা তৈরি করি
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
‘বীজ তৈরি করার সময় কাদা মাটিতে অল্প পরিমাণে পানি থাকলেই ধানের বীজতলা তৈরি করা যায়। আগে থেকে এই পদ্ধতিতে ধানের বীজতলা তৈরি করে আমরা চাষাবাদ করতাম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভেজা ধানের বীজতলা তৈরিতে করতে সমস্যাগুলো হলো-কাদা মাটিতে অল্প পরিমাণে পানি আছে এমন জমি খুবই কম। তাছাড়াও এসকল জমিতে সময়মত বীজতলা তৈরি করার মত উপযোগি জমি পাওয়া যায় না। আবার ধানের বীজতলায় কমপক্ষে ১৫ দিন পরে পানি না দিতে পারলে জমি মাটি ভেজা না থাকলে চারা মারা যায়। আর শীতের সময় মাইটালে বা পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়। জমির পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগে বীজতলা তৈরি করতে হয়।’ কথাগুলো বলেছেন আন্ধারমানিকের কৃষক গবেষক সুশীল বিশ্বাস। তিনি আরও বলেন, ‘এসকল কারণে বীজতলার চারার বয়স বেশি হয়। জমিতে গিয়ে কুশি কম ছাড়ে। ভেজা বীজতলা তৈরিতে এসকল সমস্যা সমাধানে কৃষকের মাথায় চিন্তা আসে, অন্য কোনভাবে ধানের বীজতলা তৈরি যায়। কৃষক পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে বারসিক হরিরামপুর রিসোর্স সেন্টারের সহযোগিতায় ২০১২ সালে শুকনা বীজতলা তৈরি করার অভিজ্ঞতা নিই মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষক ভাঙ্গুরা গ্রামের ইসুব আলী (৫২) নিকট থেকে। অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের জমির জন্য ও কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণা প্লটের বোরো মৌসুমে ধানের চারা তৈরি জন্য শুকনা বীজতলা করি। এই শুকনা বীজতলাই প্রথম হরিরামপুর উপজেলায় হয়।’
এই প্রসঙ্গে আন্ধারমানিকের আয়েশা বেগম (৪৫) বলেন, ‘যেকোন শুকনা জমিতে বীজতলা তৈরি করা যায়। কৃষকদের কাছে দেখে আমার শিক্ষা। তবে আগে প্রচুর বৃষ্টি হতো ও বৃষ্টির পানি জমিতে থাকত। আমরা সহজেই কেদন জমিতে বা কেদন করে বীজতলা তৈরি করতে পারতাম। জমির মাটি কাঁদা অবস্থা বুঝে, জমির সময় অনুযায়ী ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হয়। এজন্য চারার বয়স বেশি হয়। জমিতে রোপণ করলে কুশি কম দেয়, ধান কম হয়। কিন্তু ১৫ দিন আগে শুকনা জমিতে বীজতলা তৈরি করে খুব সহজে জমিতে রোপণ করতে পারি। আমাদের জন্য এই পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরিতে উপকার হয়েছে।’
অন্যদিকে বাহিরচরের কৃষক মজনু বেপারি (৫৬) বলেন, ‘শীতে মাঠ ঘাটের পানি থাকে না। যার কারণে বোরো মৌসুমে ধানের বীজতলা তৈরি করা কঠিন। কৃষকদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তা থেকে শুকনা বীজতলা তৈরি করতে পারায় আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। মাঠে পানি না থাকলেও সাদা পলিথিন দিয়ে জমি ঢেকে দেওয়ার ফলে শীত মৌসুমে কুয়াশার পানি পলিথিনের অপরপৃষ্ঠায় পড়ে জমি ভেজা থাকে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়ার জন্য বীজতলা গরম থাকে, চারা তাড়াতাড়ি বড় হয়। কুয়াশায় বীজতলা নষ্ট হয় না। শুকনা জমিতে সহজে বীজতলা তৈরি করতে পারায় কৃষকদের জন্য খুবই উপকার হয়েছে। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুরে ৯০ ভাগ কৃষক বর্তমানে শুকনা জমিতে বীজতলা তৈরি করে। আমরা অল্প বয়সের ধানের চারা রোপণ করে থাকি।’
হরিরামপুরের কৃষকগণ চিন্তা করে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করছেন। তাঁরা প্রকৃত সমস্যা সমাধানে খুবই পারদর্শী হন। তাই তো হরিরামপুর উপজেলায় ৬ বছর পরে প্রায় ৮০ ভাগ কৃষক বোরো মৌসুমে শুকনা জমিতে ধানের বীজতলা তৈরি করে চাষাবাদ করছেন। কৃষক মনে করেন, বোরো মৌসুমে শুকনা জমিতে ধান চারা তৈরি একটি সফল উদ্ভাবন। এই উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে চাষাবাদে সফল হচ্ছেন।