কৃষি উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি বনাম খাদ্য নিরাপত্তা
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ষাটের দশকের শুরুতে সবুজ বিপ্লবের নামে উন্নত তথা আধুনিক কৃষির গোড়াপত্তন হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে আরম্ভ করে। ষাটের দশকের শুরুতে আমাদের দেশের কৃষকরা তৎকালীন সরকারের ভর্তুকিতে প্রদত্ত্ব কলের লাঙ্গল, সেচ প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত ধানের (উফশী) চাষ শুরু করে। আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাতের ধান চাষ করে কৃষকরা পূর্বের তুলনায় অনেকগুণ ফলন পাওয়ায় ধীরে ধীরে দেশের সকল কৃষক শস্য চাষে উন্নত বীজ ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ে। আধুনিক কৃষির শুরুতে দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিতে যে সকল উপকরণ ভর্তুকিতে এবং বিনামূল্যে কৃষকদের দেয় তার অধিকাংশই প্রভাবশালী কৃষক, চেয়ারম্যান, মেম্বাররা নিয়ে নেয়। কিন্তু সাধারণ কৃষকরা সংকোচ করে/ভয় পেয়ে এসব সুবিধা গ্রহণ করেনা। তবে ধীরে ধীরে সাধারণ ও প্রান্তিক কৃষকরাও আধুনিক কৃষির উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পরে। সরকার কৃষি উপকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভর্তুকি দেয়ায় কৃষকরা বেশ লাভবান হতে থাকে। কিন্ত বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত ভর্তুকি অব্যাহত রাখার পর সরকার কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমিয়ে দিলে প্রান্তিক কৃষকরা অনেক সমস্যায় পড়ে যায়। কৃষি উপকরণ বাজার থেকে কিনতে হয় ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং লাভ তুলনামূলক অনেক কমে যায়। বর্তমান কৃষি সম্পূর্ণ প্রযুক্তি ও রাসায়নিক উপাদান নির্ভর। উন্নত জাতের বীজ থেকে শুরু করে ধানের চারা রোপণ, আগাছা নিড়ানো, ধান কাটা, মাড়াই ও প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সকল বিষয়ই প্রযুক্তি ও রাসায়নিকের দখলে।
কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ফলে দেশে বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেও নিরাপদ খাদ্য থেকে যাচ্ছে ভোক্তার নাগালের বাইরে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে মারফত আমরা জানতে পারি দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ। শুধু তাই নয় ধান, মাছ, আম, প্রাণীসম্পদ উৎপাদনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে ১-৫ নাম্বারে রয়েছে। অন্যান্য খাদ্যের ক্ষেত্রেও দেশ যথেষ্ট উন্নতি করেছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হলেও নিরাপদ খাদ্যের ক্ষেত্রে আমরা এখনো বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। আধুনিক কৃষিকে মূনাফা অর্জনের বড় ক্ষেত্রও বলা যায়। বর্তমান এগ্রো ফার্মিং অনেক লাভবান হওয়ায় দেশের অনেক বিনিয়োগকারী এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে বেশি। বেশি লাভের আশায় তারা ধান, সবজি, ফল-মূল, মাছ, গবাদী পশু ও পাখি (হাঁস, মূরগী) এবং মাছ উৎপাদনে অধিক হারে রাসায়নিক সার, বিষ, হরমোন, ভিটামিন প্রয়োগ করছে। ফলে খাদ্য যোগান বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদিত খাদ্য আর নিরাপদ থাকছেনা। বাংলাদেশের মাটি সকল ধরণের ফল চাষের জন্য উপযোগি। একমাত্র আপেল ছাড়া (আপেল চাষ হবার কথা এখনও শোনা যায়নি) প্রায় সকল ধরণের ফলই আমাদের মাটিতে ফলে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষি উপকরণ বিক্রেতার (ডিলার) উপকরণগুলো ব্যবহার সম্পর্কে কোন প্রশিক্ষণ না থাকা এবং অধিকাংশ কৃষক নিরক্ষর ও অল্প শিক্ষিত, তাই তারা কৃষিতে উপকরণ (রাসায়নিক) ও প্রযুক্তিসমূহ ব্যবহারে তেমন দক্ষ নয়। তাদের অনেকই মনে করেন বেশি সার, বিষ ও হরমোন ব্যবহার করলেই বেশি ফলন পাওয়া যাবে। ফসলের রোগবালাই সম্পর্কেও কৃষকরা তেমন ধারণা রাখেন না এবং নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কেও তাদের তেমন ধারণা নেই। তাই তারা প্রয়োজন/সঠিক মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি উপকরণ ব্যবহার করে। ফলে অধিক উৎপাদন হলেও উৎপাদিত ফসল/খাদ্য নিরাপদ থাকছেনা।
আমাদের বাজারে কৃষির রাসায়নিক উপকরণের সহজলভ্যতা এবং অবাধ বাজারজাতকরণের ফলে অনুমোদিত ও অনুনোমদিত কৃষি উপকরণ অবাধে বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরাও অদক্ষ বিক্রেতাদের (ডিলার) নিকট থেকে এসব উপকরণ কিনে ও তাদের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করছেন, কিন্তু উপকরণগুলোর সঠিক মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় ব্যবহার করার ফলে উৎপাদিত খাদ্য মানূষসহ সকল প্রাণ ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ থাকছেনা।
জ্যৈষ্ঠ মাসকে মধু মাস বলা হয়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে আমাদের দেশে আম, জাম, কাঁঠাল, বেল, লেবু, আনারস, কলা, গোলাপজাম, জামরুল, তালের শ্বাস, লটকনসহ হরেক রকমের ফল পাওয়া যায়। কিন্তু কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ও কোম্পানি অধিক মুনাফার লোভে অবৈধভাবে কিছু রাসায়নিক উপকরণ (ফল বড় করা, আগাম পাকানো, আগাম ফলানো, গবাদী পশু-পাখি ও মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্যে অতিমাত্রায় প্রোটিনসহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান ব্যবহার) বাজারজাত করছেন। এমনকি তারা মেয়াদ উত্তীর্ণ কৃষি উপকরণ, গবাদী পশু-পাখি ও মাছের খাদ্য ও ঔষধ মেয়াদ বৃদ্ধি দেখিয়ে বাজারে বিক্রি করায় খাদ্য নিরাপত্তা যেমন বিঘিœত হচ্ছে তেমনি সকল প্রাণী সম্পদের প্রাণেরও সংশয় দেখা দিচ্ছে। এখন দেশের সর্বত্র আম, কাঁঠাল, জাম ইত্যাদি ফলের পাশাপাশি সুস্বাদু লটকন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু টিভি চ্যানেল সূত্রে জানা গেছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা (নরসিংদি) বেশি লাভের আশায় লটকন বড় করা এবং আগাম পাকানোর জন্য গাছে থাকা অবস্থায় হরমোন প্রয়োগ করছেন, যা মানুষসহ সকল প্রাণ ও পরিবেশের জন্যও মঙ্গলকর নয়।
টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলা আনারস, কাঁঠাল, কলা ও পেঁপে চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। বিশ বছর আগেও মধুপুরে জৈব উপায়ে (শুধুমাত্র শালবনের শুকনো পাতা দিয়ে মালচিং করে) এসব ফলের চাষ হত। কিন্তু বিগত প্রায় ২০/২৫ বছর যাবৎ মধুপুরে রাসায়নিক কৃষি উপকরণের আগ্রাসন চলছে। বর্তমান সময়ে অধিক মূনাফা লোভী কৃষকরা রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করে চাষকৃত ফলের আকার বড় করার মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। জাতীয় পর্যায়ের ও বহুজাতিক কোম্পানি ফল বড় করা, আগাম পাকানো ও অসময়ে ফলানোর বিভিন্ন ধরণের হরমোন বাজারজাত করছে। মধুপুরের আনারস চাষিরা দু’ধরণের হরমোন জওচঊঘ-১৫ (চষধহঃ এৎড়ঃিয জবমঁষধঃড়ৎ) ও প্রোটোজিম (সিনজেন্টা) ব্যবহার করে আনারস অনেক বড় করে কৃত্রিম উপায়ে পাকাচ্ছে, যা মানব স্বাস্থ্য ও প্রাণীর জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। ফলের স্বাদ ও গন্ধও তেমন ভালো না। আনারস, কাঁঠাল ও কলা ছোট অবস্থায় জওচঊঘ-১৫ স্প্রে করে ভিজিয়ে দিলে আকারে বড় হয় এবং ফল বড় হলে দ্বিতীয়বার স্প্রে করে ভিজিয়ে দিলে অসময়ে ফল পেঁকে যায়। অসময়ে গাছে ‘প্রোটোজিম’ হরমোন আনারস গাছের উপর (মাইজ) স্প্রে করে ভিজিয়ে দিলে আনারসের আগাম ফলন আসে। তবে হরমোন প্রয়োগ করে অসময়ে যে আনারস ফলানো হয় এবং আকারে বড় করা হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য অনেকটা কম ক্ষতিকর বলে মনে করেন এলাকাবাসী। কারণ অসময়ে আনারসের ফলন হলেও তা প্রাকৃতিকভাবেই পাঁকে এবং খেতেও সুস্বাদু ও সুন্দর ঘ্রানের হয়। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে আগাম পাকানো আনারস, আম, কলা ও কাঁঠাল খেতে যেমন সুস্বাদু নয় এবং তেমনি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। কিন্তু মধুপুর অঞ্চলের আনারস চাষিরা বিগত ১৫/২০ বছর যাবৎ রাসায়নিক উপায়েই আনারস ফল বড় করা এবং আগাম পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করে আসছেন। আর রাসায়নিক উপায়ে উৎপাদিত ও পাকানো এসব ফল কিনে সাধারণ ভোক্তারা যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি এসব বিষাক্ত ফল খেয়ে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছে মানুষ ও প্রাণীকূল।
কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও রাসায়নিক উপকরণ নিশ্চয়ই খাদ্য নিরাপত্তা আনয়নে আর্শীবাদস্বরূপ। কিন্তু এসব উপকরণ ব্যবহারে কৃষকদের অজ্ঞতা এবং অনভিজ্ঞ ডিলার/বিক্রেতাদের মাধ্যমে অবাধে বাজারজাত করায় বর্তমানে এসব উপকরণ ও প্রযুক্তি মানুষসহ সকল প্রাণ ও পরিবেশের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বাজারজাতকৃত উফশী ও হাইব্রিড বা জিএমও জাতের শস্য ফসলের চাষ পদ্ধতি, কৃষিতে রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে ডিলার এবং কৃষকদের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কোন ধরণের উদ্যোগ না নেয়ার ফলে সাধারণ কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমন এসব ফসল বা ফল কিনে ভোক্তারাও প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই শুধু দেশের জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলেই হবে না, পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাদ্যেও নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রনালয়কে অবশ্যই সকল কোম্পানির বাজারজাতকৃত সকল পণ্যের (রাসায়নিক উপকরণ) ভালো ও খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে প্রচারণাসহ ব্যবহারের সঠিক মাত্রা ও কৌশল সম্পর্কে ডিলার ও কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যথাযথ প্রচারণা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর এটা করা সম্ভব হলেই আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষির মাধ্যমে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে। রক্ষা পাবে ভোক্তা সমাজ, সুরক্ষিত হবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ এবং লাভবান হবে আমাদের কৃষক। জয় হবে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির।