নানা সংকটে কামার শিল্প
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম:
আগে টুংটাং শব্দে কাজ চলতো কামারশালায়। চাষাবাদ কমে যাওয়ায় এখন আর কেউ কাঁচি বানায় না। এছাড়া কয়লা সংকট, কর্মচারি সংকট, ক্রেতার অভাবসহ নানা সমস্যায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে কামারশালা। চাষীরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বিদেশী প্রযুক্তির উপর। দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি কামার শিল্পের চাহিদাও দিন দিন কমছে। দেশের ঐতিহ্য বহন করে এই কামার শিল্প। কামারশালা টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতা কামনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কামাররা কেউ কাজ করছে আবার কেউবা রয়েছে বসে। কাজের অভাবে অলসতায় কাটছে তাদের দিন। বর্তমানে মানুষ চাষাবাদ কমিয়ে ঘেরের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে চাষাবাদের জন্য আর তৈরি হচ্ছে না লাঙ্গল। এছাড়া ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এই শিল্প ছেড়ে চলে যাচ্ছে দিনমজুরের কাজে। ফলে এই শিল্প বিকশিত হতে পারছে না। লোহা সব সময় পাওয়া যায়। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না ভালো মানের কয়লা।
এছাড়া কামার শিল্পের প্রধান কাঁচামাল কয়লা। এই কয়লা ছাড়া কামার শিল্প চিন্তাই করা যায় না। আগে গরাণ, সুন্দরী, বাবলা, বাইন কাঠের কয়লা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যায় মেহগনি, আম, সিরিজ কাঠের কয়লা। এই কয়লা পরিমাণে লাগে বেশি। কয়লা ভালো না হলে লোহা তাড়াতাড়ি গরম হয় না। ফলে একটা জিনিস তৈরি করতে সময়ও লাগে অনেক। তাই এই কামারশালায় কর্মব্যস্ততা কমছে দিন দিন।
রাজারবাগান এলাকার কর্মকার একাব্বর হোসেন বলেন, “কামার শিল্পের বর্তমান অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত আছি। বাপ-দাদার পেশা। লাভ না হলেও ধরে রেখেছি। ছোটবেলা থেকে আমি বাবার সাথে কাজ করতাম। এমন কোন দিন ছিল না যে বাবা চারটি লাঙ্গল আর ১০টি কাঁচি বানাতো না। একটি নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে রাষ্ট্রের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত সবার ঘরে ঘরে রয়েছে এই কামার শিল্পের যন্ত্রপাতি। এই কাজে কমপক্ষে দুইজন লোক লাগে। কিন্তু বর্তমানে এই পেশায় কেউ আসে না। আগে চাষাবাদ হতো। তাই লাঙ্গলের ব্যবহার ছিল। লাঙ্গল তৈরির কাজও করতাম। আগে আউশ চাষে নিংড়ানি, পাশনি, আচড়া ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন চাষ কমে যাওয়ায় লাঙ্গলসহ এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমেছে। মানুষ বিদেশী প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগে গরুর গাড়ি তৈরি করতাম। কিন্তু এখন আর লাগে না। তাই গরুর গাড়িও তৈরি হয় না। আগে জমিতে আমন বা বোরো ধান হতো। তখন কাস্তে, কোদাল, কাঁচির ব্যবাহার হতো বেশি। কিন্তু এখন আর আমন ধান চাষ হয় না। তাই এসব যন্ত্রপাতিও এখন আর তৈরি হয় না। এখন বেশি তৈরি করি বটি, কোদাল, দা, খোন্তা, কর্ণিক, বাইশ, ছেনি, ছোট কুড়াল, ডাইস ও কাস্তে। কিন্তু আগের মতো এখন এ শিল্পে লাভ হয় না।”
রাজারবাগান এলাকার কর্মকার মো. আকরাম হোসেন বলেন, “কামারের কাজ করে এখন সংসার চালানো বড় কঠিন। বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয়। এখন কৃষি যন্ত্রপাতি থেকে রাজমিস্ত্রির সরঞ্জাম তৈরি করা হয় বেশি। তবে কয়লা সমস্যার কারণে এখন ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। এখন কয়লাগুলো শহরের বিভিন্ন হোটেল থেকে প্রতি বস্তা পাঁচ’শ টাকায় কিনি। আগে এক বস্তা কয়লায় দুই দিন চলতো কিন্তু এখন যায় এক মাস। কাজের অবস্থা খুবই খারাপ। আগে প্রতিদিন প্রায় এক’শটির মতো কাস্তে তৈরি করতাম কিন্তু এখন ১০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারত থেকে কোদাল ও রাজমিস্ত্রির উন্নত যন্ত্রপাতি আসছে আমাদের এখানে। তাই দেশীয় জিনিসের কদর কমেছে।”
মুনজিতপুরের বাসিন্দা কর্মকার মো. ইছহাক আলী বলেন, “আমি ও আমার ভাই এখানে একসাথে কাজ করি। কামকাজ কোনমতে চলছে। আমরা এখানের স্থানীয় লোক। প্রকান্তরে আমাদের অনেক জমি ছিল। আগে খুব অভাব ছিল না। তাই লেখাপড়া শিখিনি। কামারের কাজ এমন একটি কাজ যে সারা জীবন শিখলেও শেষ হবে না। ১২ বছর থেকে কাজ শুরু করি। ৪২ বছরের মতো এই কাজ করছি। আগে বেশি কাজ হতো। যেমন গরুর গাড়ি ছিল। গরুর গাড়ির চাকার হাল তৈরি করতাম। কাঁচি, দা, বটি, রাজমিস্ত্রির ডাইচ তৈরি করতাম। লোহা সবসময় পাওয়া যায় কিন্তু কয়লা সব সময় পাওয়া যায় না। আগে এক বস্তা কয়লা ৫০ টাকায় কিনতাম কিন্তু এখন এক ঝুড়ি কয়লার দামই ৫০ টাকা। কয়লা ভালো না হলে লোহা পোড়ে না। চার’শ টাকা বস্তা দরে ইটভাটার কয়লা কিনেছি এবার। কিন্তু তাও সবসময় পাওয়া যায় না। বাজে কাঠের কয়লা দিয়ে কাজ ভালো করা যায় না।”
মুনজিতপুরের বাসিন্দা কর্মকার মো. আব্দুল গফুর বলেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই দোকান করি। কিন্তু এখনো মনে হয় সব কাজ শিখতে পারি নি। সাতক্ষীরা শহরের ভিতরে ১৩-১৪ ঘরে এই কাজ চলে। কাজ করলে টাকা, না করলে টাকা নেই। কাজের অবস্থা মোটামুটি ভালো। আমাদের কাজটা সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের। তবে দিনমজুরের কাজ যারা করে তারা আমাদের এখানে আসে জিনিস তৈরি করার জন্য। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এই শিল্পটা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। অর্ডার পেলে তারপর কাজ শুরু করি। আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো কাজ করছি। কাজ করলে কাজের অভাব নেই।”
কামার শিল্প চলছে ধুঁকে ধুঁকে। চাষাবাদ কমে যাওয়ার কারণে কামারদের তেমন কাজ নেই। কয়লা সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশের ঐতিহ্য বহনকারী এই কামার শিল্প সরকারি ভর্তুকীর মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।