পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা রূপসী ম্যানগ্রোভ
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম
ওপারে ভারত, এপারে বাংলাদেশ। মাঝখানে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী। নদীর তীর ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি কেওড়া, বাইন ও গোলপাতা গাছ। গাছের উপর দিয়ে উড়ছে অসংখ্য পাখি। পাখির কল-কাকলীতে মুখরিত পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা দেবহাটার রূপসী ম্যানগ্রোভ। যা জায়গা করে নিয়েছে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের মনে।
সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা দেবহাটা। হাজারও বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চিহ্ন রয়েছে এখানে। উপজেলার শিবনগরে প্রায় ৩১.৪৬ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি রুপসী ম্যানগ্রোভ। রূপসী ম্যানগ্রোভের বিশেষত্ব হলো, এখানে আসলেই দেখা মিলবে ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তের ব্যবধান ও মাঝখানে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদী। পাশাপাশি দেখা যাবে ইছামতী নদী বেষ্টিত এই রূপসী ম্যানগ্রোভের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
বনের প্রবেশ পথেই রয়েছে সারি সারি কেওড়া, বাইন ও গোলপাতা গাছ। এই সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবে যে কেউ। প্রধান ফটক পার হলেই দেখা মিলবে একটি রিসোর্টের। এখানে বিশ্রামও নিয়ে থাকেন পর্যটকরা। আরও দেখা মিলবে লাল, সাদা ও সবুজ রঙের ছোট ছোট বিশ্রামাগার। বিশ্রামাগার পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন বাঁশের তৈরি সিঁড়ি। সিঁড়িতে পা রাখতেই কিচির-মিচির শব্দে দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানায় হাজারও পাখি। যা তাৎক্ষণিকভাবে নাড়া দেয় তাদের আবেগকে। সুন্দরবনের গহীনে হয়ত যেতে পারে না অনেকেই। তাই আসল সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হয় পর্যটকরা। কিন্তু রূপসী ম্যানগ্রোভের ভিতর সুন্দরবনের মতো সকল ধরণের আনন্দ উপভোগ করা যায়।
বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর হাঁটালেই দেখা যায় ইছামতি নদী। কয়েকটি বাঁশের তৈরি বিশ্রামাগারও আছে এখানে। বিশ্রামাগারে বসেই উপভোগ করা যাবে নদীর সৌন্দর্য। একই সাথে দেখা যাবে ভারতের সীমানা। ভাটিতে নদীর পানি নেমে গেলেই দেখা যায় বড় একটি চর। চরে হেঁটে হেঁটে সূর্যাস্তও দেখা যায়। বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঠাণ্ডা হয় শরীর ও মন। বনের ভিতরে বাঁশের তৈরি আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে বেশ কিছুদূর।
ভিতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় রূপসী ম্যানগ্রোভের আসল সৌন্দর্য। কয়েক প্রজাতির হাজারও পাখির নিরাপদ আবাস্থল হয়ে উঠেছে বনটিতে। পাখিদের উড়াউড়ি দেখে চোখ জুড়ায় সবার। রূপসী ম্যানগ্রোভের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারও দর্শনার্থী এসে ভিড় জমাচ্ছে এখানে। রূপসী ম্যানগ্রোভ নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে সৌন্দর্য প্রেমীদের মনে । বাংলাদেশ টেলিভিশনের ত্রৈমাসিক প্রোগাম ইত্যাদির ভিডিও চিত্রে দেখানোর পর রূপসী ম্যানগ্রোভ সমগ্র দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।
ঘুরতে আসা কালিগঞ্জের মৌতলা গ্রামের সাকিব ইমরান বলেন, “আগেও এখানে এসেছি। কিন্তু এখন যেমন দেখছি তেমন ছিল না। নতুন অনেক কিছু সংযোজন করা হয়েছে এখানে। রূপসী ম্যানগ্রোভের সৌন্দর্য দেখে ও পাখির কিচির-মিচির শব্দে মন ভরে যাচ্ছে। একটা প্রশান্তি অনুভব করছি।”
রূপসী ম্যানগ্রোভের সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্বে কর্মরত মো. রোকনুজ্জামান বলেন, “প্রতিদিন প্রায় এক হাজার দর্শনার্থী আসে রূপসী ম্যানগ্রোভের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ছুটির দিনে লোক সমাগম হয় অনেক বেশি। এর মধ্যে বেশি আসে প্রিয়জনের সাথে নিরিবিলি একটু সময় কাটাতে। কেউবা আসে পরিবার নিয়ে, কেউবা বনভোজনে। আবার কেউ আসে আড্ডা দিতে বন্ধুদের সাথে।” তিনি আরও বলেন, “রূপসী ম্যানগ্রোভ তৈরি করা হয়েছে গাছ লাগানোর মাধ্যমে। সরকারিভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে নিম, শাহী বাবলা, বাবলা, কেওড়া, গোলপাতা, ওয়াটচাকা, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছও আছে।”
রূপসী ম্যানগ্রোভের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার জি. এম. বাবলু বলেন, “প্রায় ৩১.৪৬ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে দেবহাটা রূপসী ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্র। দর্শনার্থীদের আনন্দ বাড়ানোর জন্য এখানে একটি প্যাডেল বোর্ট আছে। তারা এটিতে করে পুকুরে ঘুরতে পারে। বর্তমানে পুকুরে শোভাবর্ধনের কাজ চলছে। এখানে বসার জন্য কয়েকটি চেয়ার তৈরি করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “পর্যটন কেন্দ্রের শোভাবর্ধনের জন্য ফাইবারের তৈরি বাঘ, সিংহ, হাতি, তিনটি বক, জিরাফ, কুমির, মাছরাঙ্গা, মদনটাকসহ ১৩ ধরনের জীবজন্তু আনা হয়েছে। এছাড়া পুকুরের মাঝ বরাবর একটি কফি শপ বা রেস্টুরেন্ট তৈরির কাজ চলছে। ভবিষ্যতে পুকুরের উত্তর পার্শ্বে একটি সেতু তৈরি করার পরিকল্পনা আছে।”
দেবহাটা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বকর গাজী বলেন, “প্রাক্তন চেয়ারম্যান স. ম. গোলাম মোস্তফার উদ্যোগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শিবনগরের চরে বৃক্ষ রোপণ করা হয়। দিনে দিনে এই জায়গাটি রূপসী ম্যানগ্রোভে পরিণত হয়েছে।” রূপসী ম্যানগ্রোভকে দেশের ১ নং পর্যটন হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমাদের এখানে ১৭ জমিদারের বসবাস ছিল। দেবহাটার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই মূলত এই রুপসী ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করেছি।”
উল্লেখ্য ২০১৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের আদলে এই কৃত্রিম বন তৈরির কাজ শুরু করা হয়। বন বিভাগের সহায়তায় দেবহাটা উপজেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে সুন্দরবন থেকে বীজ সংগ্রহ করে বপন করা হয় ইছামতি নদী বেষ্টিত শিবনগরের চরে। পরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নয়নাভিরাম এই রূপসী ম্যানগ্রোভ। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় বর্তমানে রূপসী ম্যানগ্রোভ পরিচালিত হচ্ছে।
যেভাবে যাবেন রুপসী ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্রে
বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে সাতক্ষীরা এসে, খুব সহজেই ভ্রমণ করা যায় রূপসী ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্রে। সাতক্ষীরা বাস স্ট্যান্ড থেকে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জের বাসে চড়ে নামবেন সখিপুর মোড়ে (ভাড়া ২৫-৩০ টাকা)। সেখান থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে বা ভ্যান যোগে সরাসরি পৌঁছানো যায় রূপসী ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্রে।
সবমিলিয়ে রূপসী ম্যানগ্রোভের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে যে কেউ। পাখির কল-কাকলীতে মুগ্ধ হয় সবাই। বাঁশের তৈরি রাস্তাগুলো আপনারই প্রতিক্ষায়। বনের গাছগুলো যেন হাতছানি দেয় পর্যটকদের।