পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম
একপাশে লোকালয় আর এক পাশে সুন্দরবন। মাঝখানে বয়ে চলেছে খোলপেটুয়া নদী। লোকালয় থেকে শুরু করে সুন্দরবনের ভিতরে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নদীর মাঝখান দিয়ে চলছিল আমাদের ট্রলার। মাঝে মাঝে মূল সুন্দরবনের গাঁ ঘেঁষেও যাচ্ছে ট্রলারটি।
নদী পথে যেতে যেতে খুব কাছ থেকেই উপভোগ করছিলাম সুন্দরবনের আসল সৌন্দর্য। ট্রলার থেকে দেখলাম লোকালয়ের মানুষগুলো কেউ গোসল করছে আবার কেউবা মাছ ধরছে নদীতে। এই নদীই যেন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এর সাথে মিশে আছে তাদের জীবন ও জীবিকার উৎস। কেউবা বন থেকে সংগ্রহ করছে জ্বালানি কাঠ যা তাদের আয়ের একমাত্র মাধ্যম। এই আয় দিয়েই চলে নদীপাড়ের হাজারো মানুষের সংসার।
কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা প্রবেশ করলাম ছোট্ট একটি খালে। এ খালের দু’পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি গেওয়া, কেওড়া, বাইন, সুন্দরী ও গরাণ গাছ। যা দেখলে খুব সহজেই অভিভূত হবে যে কেউ। পৃথিবীর একমাত্র ও বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এটি। সুন্দরবনকে চির হরিৎ বনও বলা হয়। বনের ভিতরে প্রবেশ না করলে বোঝাই যাবে না যে, সুন্দরবন আসলে এতো সুন্দর।
বনের ভিতরে হঠাৎ দেখতে পেলাম একটি মন্দির। যেখানে রয়েছে দেবতাদের মূর্তি। এখানে বনবিবির পূজা করা হয়। বনে ঢোকার আগেই মন্দিরে দর্শন দিয়ে যান অনেকে। অনেকেই বিশ্বাস করেন মন্দিরে দর্শন দিলে বনে গিয়ে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ ট্রলারটি থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে পৗঁছে গেছি আমরা। ট্রলারটি রাখা হলো পল্টনের (যেখানে ট্রলার রাখা হয়) পাশে। নেমে পড়লাম সবাই। ট্রলার থেকে নামতেই দেখা মিলল কয়েকটি বানরের। দেখে মনে হচ্ছিল আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যই বুঝি দাঁড়িয়ে আছে বানরগুলো। কিন্তু বানরগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল খুবই ক্ষুধার্থ। তাই পথ আটকে দাঁড়ালো আমাদের। খাবার দিতেই লাফ দিয়ে উঠল গাছে।
কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজমে ঢোকার পথে প্রথমে রয়েছে লোহার তৈরি একটি ব্রিজ। ব্রিজ পার হলেই দেখা মিলবে একটি বিশ্রামাগার। বিশ্রামাগার পার হয়েই বামদিকে কিছুদূর হেঁটে গেলেই দেখা যাবে একটি কাঠের তৈরি ব্রিজ।
ব্রিজটি বনের ভিতর চলে গেছে বেশ কিছুদূর। ব্রিজ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ব্রিজের দু’পাশে রয়েছে খলিশা, হরকোচা ও বাইন গাছের সারি। যা দেখে চোখ জুড়ায় সবার। আরও দেখলাম বানর, লাল কাঁকড়া ও ডাংগুলি মাছ। জানতে পারলাম সুন্দরবনে যে খাঁটি মধু পাওয়া যায়, তা খলিশা ফুল থেকেই মৌমাছিরা সংগ্রহ করে থাকে।
ব্রিজের বাম পাশেই রয়েছে একটি বাইন গাছ। এখানে যে আসে সে একবার এই বাইন গছের উপর উঠে ছবি তুলে যায়। সবাই বলে এই গাছের উপর ছবি না তুললে সুন্দরবনে ঘোরার মজাটাই যেন পাওয়া যায় না।
ব্রিজ পার হলেই দেখা মিলবে আরও একটি বিশ্রামাগার। এখানে বসে একটু বিশ্রাম নিলাম। বিশ্রামাগারে বসতেই প্রায় ১০-১৫টির মতো বানর এসে জমায়েত হয়েছে এখানে। দর্শনার্থীরা মুড়ি, চিপস ও বিস্কুট দিয়ে অ্যাপায়ন করছে বানরদের। ক্ষুধার্থ বানরগুলো খাবার পেয়ে খুব খুশি মনে খাচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল কতদিন কোন খাবার খায়নি এরা।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখতে পেলাম একটি চিত্রা হরিণ খাবারের খোঁজে এদিক ওদিক হাঁটছে। এই সুযোগে হরিণের সাথে একটি সেলফিও তুলে ফেললাম। ছবি তোলাও শেষ, হরিণটাও দৌড়ে পালালো।
এছাড়া কালাগাছিয়া ইকোট্যুরিজমে রয়েছে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ওয়াচ টাওয়ার। এই টাওয়ারে উঠে খুব সহজেই সুন্দরবনের ভিতরে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখানে আসলে সবাই একবার ওয়াচ টাওয়ারে উঠে সুন্দবনের গহীনে চোখ বুলিয়ে যায়। টাওয়ারে উঠে কেউবা তোলে সেলফি আবার কেউবা উপভোগ করে সুন্দরবনের সৌন্দর্য।
টাওয়ার থেকে নেমেই দেখতে পেলাম নরম কাদায় খেলা করছে ডাংগুলি মাছ। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। চলে আসলাম সামনের ফটকে। এখানে এসে দেখতে পেলাম একটি হরিণের গলায় হাত বুলাচ্ছে একজন ও অপরজন পাতা খাওয়াচ্ছে। ইকোট্যুরিজমের সামনের দিকে রয়েছে একটি পুকুর, একটি ফাঁড়ি, একটি মসজিদ ও হরিণ রাখার জন্য বেষ্টনি দেওয়া একটি বড় জায়গা।
ভ্রমণ শেষে চলে আসার পথে কতগুলো বানর আমাদেরকে বিদায় জানালো। ফিরে আসলাম আমাদের ট্রলারে।