শতবাড়ি: আমার উন্নয়ন আমার পরিবর্তন

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

শ্যামনগর উপজলোর কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামে অর্চনা রানীর বাস। তার বাড়িটি ‘পুষ্টি ব্যাংক’ বা শত বাড়ি হিসাবে চিহ্নিত। মোট বসতভিটার পরিমাণ ৪১ শতক, যার মধ্যে ফসল চাষাবাদের করেন ৩৬ শতক জায়গায। বাকি জায়গায় বসত ঘর, পুকুর, বাঁশ ক্ষেত এবং কিছুটা পরিত্যাক্ত থাকে। ৩৬ শতক জায়গায় বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ করেন। এমন কোন ফসল নেই যা তার বাড়িতে চাষ হয় না। পুকুরে নানান ধরনের স্থানীয় মাছ চাষ করেন।

সব কিছু মিলে অর্চনা রানীর বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। তার বাড়িতে বারোমাস বিভিন্ন ধরনরে সবজি, মসলা, ডাল চাষ হয়। তার বাড়িতে সবজির মধ্যে মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, লাউ, ঝিঙা, তরুল, চালকুমড়া, শসা, পাতাকপি, উচ্ছে, খিরাই, কচুরমুখী, বরবটি, আলু, ওলকপি, ঢেড়স, ওল, লাল শাক, মূলা, গাজর, পুইশাক, কলা, পেপে, চুবড়ি আলু, পালনশাক, বীটকপি, ডাটাশাক, কচু, কলা, পেপে, ঝাল, টমেটো, কচু, লাউ চাষ হয়। আর মসলার মধ্যে ধনে, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা, জিরা, এলাচ। ডালের মধ্যে কলুই এবং তেল এর মধ্যে সরিষা চাষ করেন।


এছাড়াও ফলজ গাছের মধ্যে তার বাড়িতে আছে আম, জাম, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, জামরুল, লিচু, তাল, খেজুর, কলা, ছবেদা, নারকেল, সুপারি, পাতিলেবু, কাগছিলেবু, পেপে, শাকআলু, আমড়া, পান, পেয়ারা, কুল, সজিনা, আনারস, বেল, ডুমুর, গাব গাছ। অচাষকৃত উদ্ভিদের মধ্যে থানকুনি, হেলাঞ্চ, বৌনুটি, আদাবরুন, আমরুল, তেলাকচু, সেঞ্চী, নোনাশাক, কাথাশাক, গিমেশাক, দূর্বা, তুলসি, কলমিশাক আছে। পুকুরে মাছের মধ্যে আছে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার, টেংরা, পুটি, ট্যাবলেট, জাপানিপুটি, শোল, কই, তোড়া, মরুল্য, কাঁকড়া, চিংড়ি, তেলাপিয়া, বাইন, মাগুর মাছ। সাথে প্রাণী সম্পদের মধ্যে আছে মুরগি ১৪টি, হাঁস ৬টি, ছাগল ৪টি, গরু ৫টি, কবুতর ৩টি।

বারসিক’র ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসাবে মাঠ পর্যবেক্ষণ ও যোগাযোগের মাধ্যমে অর্চনা রানীর সাথে যোগোযোগ হয়। তার কাজকে গতিশীল করতে ধারাবাহিক সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রয়েছে। তার কাজের আগ্রহী এবং নানান ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখায় গত বছর আগস্ট ২০২০ সালের দিকে কোভিড-১৯ মহামারীকালে পুষ্টিভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে তৈরিকৃত ‘পুষ্টি ব্যাংক’ বা শত বাড়ি তৈরির লক্ষ্যে অর্চনা রানীর বাড়িটি চিহ্নিত করা হয়। আর সেখান থেকে তিনি তার কাজগুলো আরো সমৃদ্ধ করার কাজ চলমান রেখেছেন।

এ বিষয়ে অর্চনা রানীর কাছে শত বাড়ি তৈরি হওয়াতে তার কি ধরনের উপকার হয়েছে বা এলাকায় তার কি ধরনের প্রভাব পড়ছে,া কিভাবে অন্যরা উৎসায়িত হচ্ছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। স্বামী একজন দিনমজুরী। মাঝে মধ্যে এলাকার বাইরে ভাটা ও ধান কাটার কাজে যান। আমাদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস হলো বসতভিটায় সবজি চাষ। যা আমি শশুর বাড়ি এসে সেখান থেকে করে চলেছি। আর আমার বাড়ি ‘শতবাড়ি’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়াতে এখানে এখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। যার মাধ্যমে আমরা আগ্রহী ও উদ্যোগী হয়ে বীজ, সবজি, গাছের চারা, তথ্য আদান প্রদান করতে পারি। আমার বাড়িতে এখন বিভিন্ন ধরনরে মসলা যেমন আদা, হলুদ, জিরা, কালোজিরা, পেযাজ, রুসুন, দারুচিনি ইত্যাদি চাষ হয়। অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য প্লট আছে, ভার্মি কম্পোষ্ট নিজে যেমন ব্যবহার করি তেমনি অন্যরা তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছে। মৌসুম বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘গতবছর থেকে শত বাড়ি তৈরি হওয়াতে প্রায় ৩৫টি পরিবারের মাঝে করোনাকালীন সময়ে নানান ধরনের সবজি দিযে সহায়তা করেছি। এছাড়াও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাড়ি থেকে এসে সবজি কিনে নিয়ে যান। প্রায় ২০টি পরিবারের মাঝে লাউ, শিম, বরবটি, উচ্ছে, লালশাক, পালনশাক ও কচুর বীজ দিয়েছি। এছাড়াও প্রতিদিন গ্রামের কেউ না কেউ বাগান থেকে অচাষকৃত শাক তুলে নিয়ে যান।’


অর্চনা রানী আরো জানান, শত বাড়ির পাশাপাশি তিনি গ্রামের নারীদের নিয়ে একটি নারী সংগঠনও তৈরি করেছেন। সেখানেও বিভিন্ন ধরনরে আলোচনা, প্রশিক্ষণ, মেলা ও সঞ্চয় কার্যক্রম চালু রয়েছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারসিক’র যোগাযোগ সহায়তার জন্য একটি ডিপ টিউবওয়েল পেয়েছেন, যা দিয়ে তাঁর কৃষি কাজকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন সাথে গ্রামের মানুষের সুপেয় পানির সমস্যা লাঘব হয়েছে।’


পুষ্টি ভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে তৈরিকৃত ‘পুষ্টি ব্যাংক’ বা শত বাড়ি যেমন নিজের পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধকরণে আগ্রহী ও উদ্যোগী করে তুলছে। তেমনি গ্রামের অন্য পরিবারের মাঝে নানান ধরনের সম্পদ আদান প্রদানে ভূমিকা রাখছে। এ বাড়ি দেখে যেমন অন্যরা আগ্রহী ও উদ্যোগী হচ্ছে।

happy wheels 2

Comments