রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মাটির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম, অমিত সরকার ও শহিদুল ইসলাম শহিদ
চিরচেনা বরেন্দ্র অঞ্চলের জলবায়ু দিনে দিনে পরিবর্তন হওয়ার কারণে ফসল চাষের সমস্যা আরও বেড়েছে। এলাকার পুরাতন জাতগুলো এলাকা সহনশীল হলেও সেগুলো সংরক্ষণ ও জমিতে চাষ কম হয় বলে দিনে দিনে এগুলো বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়া যত্ন এবং উদ্যোগের অভাবে পুরাতন জাতগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। স্থানীয় কৃষি ফসলের জাত সরকারিভাবে সংরক্ষণ করার কোন উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে আধুনিক কৃষিফসল আবাদের ক্ষেত্রে নানান রোগ ও পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কৃষকরা। রাসায়নিক ও কীটনাশক দিয়ে মাটির ক্ষতি তো হচ্ছে। আবার দেখা যায় অতিরিক্ত রাসায়নিক দিলে প্রতিকুল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না ফসলগুলো।
যদিও স্থানীয় জাতগুলোতে ফলন কম তারপরেও স্থানীয় কৃষকরা মনে করে, ‘জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক না দিলে এবং স্থানীয় প্রজাতির ফসল আবাদ করলে বিরূপ তাপমাত্রার মধ্যেও এ ফসলগুলো ভালো ফলন দেয়। কারণ এসব জাতগুলো এলাকার পরিবেশের সাথে মানানসই এবং স্থানীয় আবহাওয়া উপযোগী। দুর্যোগ সহনশীল এ জাতগুলো যদি কৃষক ব্যবহার করেন এবং জমিতে আবাদ করেন তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তারা হ্রাস করতে পারে বলে অভিমত অনেক কৃষক। ফসল চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার করলে রোগ ও পোকা কম হয়, ফসলও সুস্থ থাকে।
জলবায়ু বিরূপ আচরণে কৃষকরা ধান বাদ দিয়ে অন্য ফসল চাষের দিকেও মনোযোগী হচ্ছেন যদিও তাতেও তাদের ক্ষতি কোন অংশে কম নয়। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চলতি আউশ মৌসুমের শুরুতে এবার কাক্ষিত বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে আউশের চাষ ব্যাহত হয়েছে। তৃণমূল কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই অঞ্চলের আউশ আবাদ মূলতঃ বৃষ্টিনির্ভর। বর্ষা মৌসুমের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেলেও, কাঙ্খিত বৃষ্টি হয়নি। ফলে আউশ ধানের ক্ষতি প্রতিবছরই বাড়ছে। উপরোন্তু বাজারে ধানের মূল্য না থাকায় কৃষগণ ভুট্টা, পাট ও সবজি চাষে ঝুঁকে পড়ছে। কিন্তু এখানেও বাজারের অবস্থা স্থিতিশীল নয় বলে অনেকসময় ক্ষতির শিকার হন কৃষকরা। রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ মৌসুমে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে আউশের চাষ কম হয়েছে।
এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কৃষকরা নানান দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নত জাত ও রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে সমস্যা থেকে উত্তরণে তাদের প্রচেষ্টা উল্টো তাদের বিপদে ঠেলে দিয়েছে। কেননা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগে তারা দেখেছেন যে, ফসলগুলোতে রোগ ও পোকার আক্রমণের হার বেড়েই যাচ্ছে। এছাড়াও জমিতে রাসায়নিক আগাছানাশক ব্যবহার করলে জমির ধান লাল হয়। ধানের বৃদ্ধি প্রক্রিয়াও এক পর্যায়ে থেমে যায়। এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারে মাটিরও ক্ষতি হয় বলে পরিবেশবিদরা বলেছেন। কিন্তু স্বল্প সময়ের ভেতরে সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষকরা রাসায়নিক আগাছানাশকসহ কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে করে পরিবেশ তো ক্ষতি হচ্ছেই সাথে সাথে মাটির ভেতরে থাকার অণুজীবগুলোও রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। এসব অণুজীব ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যেমন কেঁচো। এ প্রসঙ্গে গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের আলোকছত্র গ্রামের মজিদ খান বলেন, ‘আমরা জমিতে আগাছানাশক ব্যবহার করছি। ফলে জমির ধান লাল হওয়া ও ধান থেমে যাওয়ার বিষয়টি সকলের চোখে পড়ে। কিন্তু মাটির কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কারো ধারণা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে শহরের আবহাওয়া দূষিত ও গ্রামের আবহাওয়া দূষণমুক্ত মনে করা হতো। বর্তমানে জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে গ্রামের বাতাসও দূষিত হচ্ছে। উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এই প্রক্রিয়া থেকে আমাদের বের হওয়া জরুরি।”
বরেন্দ্র অঞ্চলের তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক ইফসুফ আলী মোল্লা, তানোর সদরের নুরজ্জামান মিয়া এবং নওগাঁ পত্নীতলা উপজেলার নাসির উদ্দিন। এই তিনজন অভিজ্ঞ কৃষক স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা করে সফলতা লাভ করে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের দেখানো পথ আরও অনেক কৃষক অনুসরণ করে রাসায়নিক ও কীটনাশকনির্ভর পরিবেশবিনাশী কৃষিকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন! অভিজ্ঞ কৃষক তানোরের ইউসুফ মোল্লার জৈব কৃষির সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে নওগাঁর কৃষক নাসির উদ্দিন জৈব কৃষির চর্চা শুরু করেন। একইভাবে কৃষক নুরুজ্জামান মিয়া তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে জৈব কৃষি চর্চা করে সফলতা লাভ করেছেন। জৈব কৃষি চর্চায় এই তিনজন কৃষকের সাফল্যে অন্য কৃষকরা আশান্বিত হয়েছেন যে, তারা রাসায়নিক ও কীটনাশকনির্ভর কৃষির মায়াজ্বাল থেকে নিজেদের উদ্ধার করবেন; উৎপাদন খরচ হ্রাস করাবেন এবং পরিবেশকে, মাটিকে সুস্থ করার মধ্য দিয়ে সবার ভালো থাকা নিশ্চিত করবেন।
তাদের মতে, এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় জাতগুলো থেকে এলাকা উপযোগী ও দুর্যোগ সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। কিছু কিছু কৃষক স্থানীয় জাত ব্যবহার করে সফল হয়েছেন। তবে বৃহৎ পরিসরে এই স্থানীয় জাতকে সংরক্ষণ ও আবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন