কম্পোস্ট ও সবজির গ্রাম রাজেন্দ্রপুর
নেত্রকোনা থেকে শংক ম্রং
নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের একটি গ্রাম রাজেন্দ্রপুর। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী, কৃষিই তাদের মূল পেশা। এ গ্রামের কৃষকরা তাঁদের তুলনামূলক নিচু জমিতে ধান এবং উঁচু জমিতে প্রায় ১৮/২০ বছর যাবৎ বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে পরিবারের খরচ নিবারণ করে আসছে। শুরুতে এ গ্রামের কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে সবজি চাষ করতেন। দিন দিন জমির উর্বরাশক্তি কমে যাওয়ায় এবং অধিক ফলনের আশায় অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে সবজি ফসলে পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি পায় এবং তা দমনে রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। কিন্তু খরচের তুলনায় তেমন ফলন না হওয়ায় কৃষকরা কৃষি ফসল করে তেমন লাভবান হতে পারছিলেন না। কৃষকরা রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জমিতে গোবর সার ব্যবহার করলেও গোবর সংরক্ষণ পদ্ধতির ত্রুটির জন্য (খোলা স্থানে গোবর রাখা) গোবর সার মানসম্মত না হওয়ায় ফসলের তেমন উপকার হতোনা। কৃষকরা অন্য কোন উপায় না পেয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগে যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শে গ্রামের ৪০ জন কৃষক নিয়ে রাজেন্দ্রপুর গ্রামে ২০০৬ সালে একটি আইপিএম কৃষি সংগঠন গড়ে তোলেন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাগণ নিয়মিত সংগঠনে গিয়ে সদস্যদের আইপিএম পদ্ধতিতে ফসলের রোগ-বালাই দমন ও শস্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করে আসছেন।
বারসিক ২০১৫ সালে রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকদেরকে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানায় এবং আগ্রহী দু’জন কৃষককে কেঁচো দিয়ে সহযোগিতা করেন। কেঁচো কম্পোস্ট এর উপকারিতা মাঠ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ করে এলাকার অন্যান্য কৃষকরাও বারসিক থেকে কেঁচো সংগ্রহ করে নিজ নিজ উদ্যোগে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করতে আরম্ভ করেন। পরবর্তীতে উপজেলা কৃষি বিভাগ দু’জন কৃষককে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনে উপকরণ সহযোগিতা দিয়েছে। বর্তমানে সংগঠনের ৪০ জন সদস্যই কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে সবজি চাষ করছেন। আবার কোন কোন কৃষক অতিরিক্ত কম্পোস্ট বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছেন।
আইপিএম কৃষি সংগঠনের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সংগঠনের ৪০ জন কৃষক প্রায় ১০ একর জমিতে জৈব সার ও কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করে বৈচিত্র্যময় সবজি ও হলুদ চাষ করছেন। সংগঠনের সভাপতি মো. বাদশা মিয়া বলেন, “আগামী ৫/৬ বছরের মধ্যে সংগঠনের উদ্যোগে রাজেন্দ্রপুর গ্রামকে শতভাগ কম্পোস্ট গ্রাম ও রাসায়নিকমুক্ত সবজি গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সংগঠনের সদস্যরা কোন কৃষক (পার্শ্ববর্তী গ্রাম বা দূরের কোন গ্রাম) কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য কেঁচো সহযোগিতা চাইলে বিনামূল্যে কেঁচো দেওয়া হয়।” তিনি জানান, কৃষকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় কৃষকের নিকট প্রতি কেজি কেঁচো ১০০০-১৫০০ টাকা দরে এবং কম্পোস্ট ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। গ্রামের প্রায় সকল চাষিই প্রতিবছর গড়ে ৫-৬ কেজি করে কেঁচো বিক্রি করেন। তবে বেশিরভাগ কৃষক উৎপাদিত কেঁচো কম্পোস্ট নিজেদের জমিতে সবজি চাষের জন্য ব্যবহার করেন। দরিদ্র কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কেঁচো কম্পোস্ট অন্য কৃষকদের নিকট বিক্রি করেন।
সংগঠনের সভাপতি বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমি কম্পোস্ট বিক্রি করিনা, আমার উৎপাদিত সমস্ত কেঁচো কম্পোস্ট সবজির জমিতে ব্যবহার করি। কৃষি অফিসারের অনুরোধে আমি একবার ১০০ কেজি কেঁচো কম্পোস্ট ১০ টাকা দরে ১০০০ টাকায় বিক্রি করেছি। তিন বছরে প্রায় ২৫ কেজি কেঁচো ১০০০ টাকা/কেজি দরে ২৫০০০ টাকায় বিক্রি করেছি।” তিনি আরও বলেন, “কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে সবজি চাষ করায় সবজি খুব ভালো হচ্ছে এবং খেতেও সুস্বাদু। গ্রামের প্রায় সকল কৃষক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে কেঁচো কম্পোস্ট বেশি ব্যবহার করে সবজি চাষ করছেন। আমাদের গ্রামের সবজির বাজার চাহিদাও বেশি, তাই কৃষকরা সবজি চাষ করে অনেক লাভবান হচ্ছে। আমরা আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যে ১০০ ভাগ জৈব কৃষি করার আশা করছি।”
কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন অনেক সহজ, শুধুমাত্র গোবর, পচা খড় পাকা হাউজ, মাটি বা পাকা চাড়িতে দিয়ে তাতে কেঁচো পরিমাণমত ছেড়ে দিয়ে উপর ছাউনি বা ঢেকে দিয়ে অন্ধকার করে দিলেই হলো। শুধু খেয়াল রাখা যেন বৃষ্টির পানি বা রোদ না পড়ে এবং হাঁস-মূরগি, পাখি বা পিপড়া না খেয়ে ফেলে। ২-৩ মাসের মধ্যেই কম্পোস্ট তৈরি হয়। কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহারে সবজির ফলন খুবই ভালো হয় এবং মাটির র্উবরতা বৃদ্ধি পায় এবং ফসলে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হওয়ায় রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকরা এখন জৈব কৃষির প্রতি ঝুঁকছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কৃষকরা গ্রামজুড়ে কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করে বৈচিত্র্যময় সবজি যেমন-মুলা, ডাটা, লাউশাক, সীম, লাল শাক, হলুদ, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও টমেটো চারা ইত্যাদি চাষ করেছেন। এভাবে সকল গ্রামের কৃষকরা জৈব কৃষি চর্চা করলে খাদ্য উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি ভোক্তার নিরাপদ খাদ্য সুনিশ্চিত হবে এবং নিশ্চিত হবে সকলের জন্য বৈচিত্র্যময় খাদ্যের। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে অণু, জীবাণু তথা প্রাণবৈচিত্র্য, রক্ষিত হবে কৃষি পরিবেশ ও প্রতিবেশ।