নিভৃত সংগ্রাহক মানিকগঞ্জের লিয়াকত আলী খান

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥

শখের বশে মানুষ কত কিছুই না করেন! মনের ভেতরের গুণগুলো অনেকেই সযতেœ লালন করেন নিভৃতে-নীরবে। ৬১ বছরে পা দেওয়া তেমনি একজন ব্যতিক্রমী স্বপ্নচারী মানুষ লিয়াকত আলী খান। তাঁর কর্ম পরিধিই তাঁকে এনে দিয়েছে আট-দশজন মানুষের চেয়ে ভিন্ন পরিচিতি। মানিকগঞ্জ জেলা শহরের পোড়রা এলাকায় তাঁর বাড়ি।

লিয়াকত আলী খানের সংগ্রহের শুরুর কথা
১৯৪৮ সালের ৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন লিয়াকত আলী। পড়াশোনা তাঁর খুব একটা করা হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা হয়নি তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের আগে জেলা শহরের বাজার সেতুর কাছে বাবা মাজেদ আলী খানের চায়ের দোকান ছিল। সে সময় শিশু লিয়াক01ত চায়ের দোকানে বাবাকে সহযোগিতা করতেন। তখন বয়স ৮ কি ১০ বছর। একদিন বাড়ি থেকে বাবার চায়ের দোকানে যাওয়ার পথে ব্রিটিশ আমলের এক পয়সার একটি রৌপ্য মুদ্রা কুড়িয়ে পান। মহামূল্যবান ভেবে সযতেœ রেখে দেন। মুদ্রাটিকে মহা মূল্যবান মনে করে বড়দের চোখ এড়িয়ে সেটি নিয়ে দূরদূর বুকে হাজির হয়েছিল স্যাকরার দোকানে । নাম ভূলে যাওয়া সোনা –রূপার ওই ব্যবসায়ী সেদিন কুড়িয়ে পাওয়া মুদ্রাটি ফিরিয়ে দিয়ে তাকে বলেছিলেন ‘এটি কেনা যাবে না । এমন আরো কটি জমলে তার পর এসো।’ এ ঘটনা থেকে তাঁর মনে চিন্তা আসে, কীভাবে আরও মুদ্রা জোগাড় করা যায়। যেই চিন্তা সেই কাজ। আশপাশের পরিচিত-অপরিচিত মানুষদের কাছ থেকে একটি-দু’টি করে জোগাড় করতে থাকেন দেশ-বিদেশের ধাতব মুদ্রা। কিন্তু এরই মধ্যে কখন যে এসব মুদ্রার প্রতি মায়া জন্মেছিল, টের পাননি লিয়াকত আলী। এরপর থেকে মুদ্রা সংগ্রহ করা নেশায় পরিণত হয়ে গেল। প্রথম দিকে এসব মুদ্রা তিনি দোকানে সংগ্রহ করে রাখতেন।

বিরল মুদ্রা আর দূর্লভ লটারির টিকিট সংগ্রহ
১৭০টি দেশের ৩ সহস্রাধিক মুদ্রা, কাগুজে নোট আর লটারির টিকিটের দুর্লভ সংগ্রহ করেন লিয়াকত আলী খান। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত সব লটারির টিকিটও সংগ্রহে রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। ‘মুদ্রা সংগ্রহকারী লিয়াকত’ নামেই তিনি মানিকগঞ্জবাসীর কাছে পরিচিত। পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। গত বছর দুই তিন ধরে অসুস্থ হওয়ায় মানিকগঞ্জ শহরে বাসায় পাখি ও তাঁর সংগ্রহশালা দিয়ে কাটাচ্ছেন প্রায় পুরোটা সময়। ইচ্ছা ছিল সারা বিশ্ব ভ্রমণ করবেন, আর্থিক অসংগতির কারণে সেটি আর হয়ে উঠেনি। তাই তো তিনি দেশি-বিদেশি নোট, মুদ্রাসহ গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত সবগুলো লটারির টিকিট সংগ্রহ করে বিশ্ব ভ্রমণের শখ মিটিয়ে যাচ্ছেন।
02
শুধূ মুদ্রাই নয়, মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়ে লিয়াকত আলীর নিজের অজান্তেই লটারি টিকিট দূর্লভ আরেকটি সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন । সহধর্মীনি মারা গেছেন কয়েক বছর পূর্বে। পাখি আর সংগ্রহশালাই এখন তার জীবন। নিরাপত্তার কথা ভেবে কোথাও বেড়াতে যান না তিনি। ১৯৬৯ সালের ঘুর্ণিদুর্গতদের সাহায্যার্থে রেডক্রসের ১ টাকার লটারির টিকিট থেকে শুরু করে চলতি জানুয়ারি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সাহায্যার্থে বিত্রয়রত লটারির টিকিটও সংগ্রহ করেছেন তিনি। লিয়াকত আলী খানের দাবি, ১৯৬৯ সালের পাকিস্তান থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের অনুমোদিত সবগুলো লটারির টিকিট তাঁর কাছে আছে। তার বিশ্বাস, ধাতব মুদ্রার মতো অর্থনৈতিক মূল্য না থাকলেও এসব দেশের লটারির টিকিটের একটি ঐতিহাসিক মূল্য নিশ্চয়ই আছে ।

পাখির জন্য ভালোবাসা
এই মুদ্রা সংগ্রাহকের ভালোবাসা আছে পাখির প্রতিও। সকাল ৫ টায় তাঁর ঘুম ভাঙে পাখির আওয়াজে। প্রতিদিন প্রায় সহস্রাধিক শালিক, দোয়েল, ঘুঘুসহ আরও কয়েক রকম পাখি ভিড় করে বাড়ির উঠানে খাবার খাওয়ার জন্য। লিয়াকত পাখিদের আপ্যায়ন করেন মুড়ি ও চানাচুর দিয়ে। দিনে দিনে পাখির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এ কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পান তিনি।
03
লিয়াকত আলীর কথা
১৯৭২ সালে তার সংগৃহিত সবকিছু চুরি হলেও আবার সে সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। নানা জনে নানা কথা বলেছেন, গুরুজনেরা তিরষ্কার করেছেন। উপহাস করতে ছাড়েনি অনেকেই তবুও তার নেশা কাটেনি। বরং নেশা ধরে গিয়েছিল সংগ্রহের। লিয়াকত আলী খান তার মুদ্রা সংগ্রহের এমন তথ্য দেয়ার পাশাপাশি বলেন, “বিরল মুদ্রার খোঁজ পেয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গেছি। এমন ও ঘটনা ঘটেছে,  পুরেনো বকে পয়সার তামার মুদ্রাও কিনেছে হাজার টাকা দিয়ে। আমার এ নেশার কথা দীর্ঘ দিন গোপন রেখেছি। কিন্তু এক সময় বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশি,  আত্মীয়রা জেনে গেছেন। গোপন রাখা যায়নি। এতে আমার লাভই হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এখন আমার হয়েছে  আমার বন্ধু-প্রতিবেশিরাই বিভিন্ন দেশের কয়েন পেলে আমার জন্য তা সংগ্রহ করে রেখে দেয় বা আমার বাড়িতে পৌছে দেয়। চেনা পরিচিত জনের বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পথে সেসব দেশের নতুন ও পুরোনো মুদ্রা আমার জন্য নিয়ে আসেন।” লিয়াকত আলী খান বিশ্বের সবগুলো দেশের মুদ্রা সংগ্রহ চেষ্টাকে নিজে নিজেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস দু’এক বছরের মধ্যে তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হবে। তাঁর কাছে অনেকগুলো মুদ্রা আছে যেসব মুদ্রা কোন সময়ে কোন দেশে  তা এখনও তিনি বুঝে উঠতে পারেনি । অনেককে সেসব দেখিয়েছেনও , কিন্তু কেউ তাঁর রহস্য ভেদ করতে পারেনি। আরবি, ফার্সি, কোনো ভাষার সঙ্গে এসব মুদ্রার বর্ণ মেলেনি। বেশ কয়েকটি মুদ্রা আছে যেগুলো কোনো ধরনের কোনো কিছুই লেখা নেই। ধাতব মুদ্রার সাথে তিনি শতাধিক দেশের কাগজের নোট ও সংগ্রহ করেছেন। এ সব নোটের মধ্যে স্বাধীন বাংলা দেশের নোটও রয়েছে ।

লিয়াকত আলীর সহধর্মীনি মারা গেছেন কয়েক বছর পূর্বে। তিন ছেলে সাঈদ হোসেন খান, রাজীব হোসেন খান ও রাকিব হোসেন খান জেলা শহরে ব্যবসা করেন। ৬৯ বছর পা দেওয়া লিয়াকত আলী খানের আকাঙ্খা পৃথিবীর সবগুলো দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করা এবং তাঁর এ সংগ্রহশালার একটি জাতীয় প্রদর্শনী করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবেন।

happy wheels 2