নিজে লেখাপড়া করতে পারি নাই কিন্তু...

নিজে লেখাপড়া করতে পারি নাই কিন্তু…

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা

কলমাকান্দা উপজেলা শহর থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত বিশারা গ্রাম। গ্রামটি যদিওবা উপজেলা শহরের পাশেই অবস্থিত কিন্তু ১২ মাসের মধ্যে ৭-৮ মাসই উপজেলা শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। কারণ এই গ্রামটিতে যাওয়ার নেই কোন ভালো রাস্তা। তাই বর্ষাকালে এখানকার লোকজন নৌকায় করে কলমাাকান্দায় আসেন কেউ বাজার করতে, কেউ বা ব্যবসা করতে, কেউ বা লেখাপড়ার করতে, কেউ বা কাজের সন্ধানে। অনেক দিনের অনেক প্রত্যাশার পর এবছর সরকারি সহযোগিতায় বিশারা যাওয়ার রাস্তাটি তৈরি করা হলো। আজ থেকে একবছর আগেও এখানের যাতায়াতের কোন সুব্যবস্থা ছিল না।

এমন প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রামটি অবস্থিত হওয়ায় এখানকার শিশুরা শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত। এর জন্য আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে বার বার বন্ধ হয়েছে। তারপর অনেক দিন পর আজ প্রায় ৬ বছর যাবৎ এই বিদ্যালয়টি আবারও পূরোদমে নিয়মিত চলছে। স্থানীয় কিছ্ ুসচেতন ব্যক্তিদের উদ্যোগে এখানে বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় তিলে তিলে এই বিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে জাতীয়করণ হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে জায়গা বা স্থানের দরকার ছিল সে জমি বা স্থানটি দান করার জন্য স্থানীয় অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি থাকার পরও কেউই এগিয়ে আসেননি। অবশেষে এগিয়ে আসেন শেখ দুলাল (৫৬) নামের এক উদার মনের ব্যক্তি। যার দানকৃত জমিতে বর্তমানে টিনসেট একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।

IMG_20180402_142339
প্রতিবছর এই বিদ্যালয় থেকে সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে শেখ দুলাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের মোট ১৯২ শতাংশ জমি থেকে ৩৬ শতাংশ জমি দান করেছিলেন। শেখ দুলালের এই নিঃস্বার্থ দানের জন্যই জন্য আজ বিশারা গ্রামে শিশুরা লেখাপড়া শিখতে পারছে। “এলাকায় কোন শিকক্ষিত মানুষ নাই, ইসকুলও নাই, হেই লাইগ্যা জমিন দা দান করসি যাতে এলাকার বাচ্চা কাচ্চা লেহাপড়া করতে পারে, নিজে লেখাপড়া করতে পারি নাই কিন্তু বাচ্চা কাচ্চাদের লেখাপড়া করার সুযোগ তো তৈয়ার করণ লাগবো না কি কন?”। এমন করেই বলছিলেন বিদ্যালয়ের জন্য জমি দানের কথা। তার দান করা জমিটির কিছু অংশ ছিল তার কষ্টের টাকায় কেনা ও কিছু অংশ স্ত্রীর পৈত্রিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।

যিনি এলাকার কথা চিন্তা করে নিজ স্বার্থ বিসর্জন করেছেন। কিন্তু আজ সেই শেখ দুলালের দিনকাল কেমন চলছে? সরেজমিনের গিয়ে দেখে গেছে যে, ৫ ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী এই নিয়ে তার পরিবার। তার বড় মেয়ে একজন প্রতিবন্ধি ব্যক্তি। একটি টিনের ছাপড়া ঘর কোন রকম দাঁড়িয়ে আছে। সংসার চালানোর জন্য অন্যের বাড়িতে গিয়ে বাৎসরিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। জমিজমা বা সম্পদ হিসেবে আছে শুধুমাত্র ৪০ শতাংশ জমি। ভিটা বাদে যেটুকু থাকে সেখানে ধান করেন কিন্তু সেটি তার সংসারের জন্য পর্যাপ্ত না। অন্যের কাছ থেকে লিজ নিয়ে এবার কিছু ধান করেছেন। তারপরও বছরের খোরাকের নিশ্চয়তা দিতে পারছেন তিনি। অন্যের কাছ থেকে গরু ভাগি এনে পালন করছেন। সব মিলিয়ে অনেক কষ্টে তার সংসার চলছে। সবদিক সামাল দিয়ে কখনো কখনো তিনি উপলব্ধি করেন যদি শিক্ষিত হতে পারতেন তবে হয়তো এমন কষ্ট করতে হতো না। তিনি চান কেউ যেন তার মত এমন ভূল না করেন।

বিভিন্ন পারিপার্শি¦ক সমস্যার কারণে নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট বা অভিমান ছিল লেখাপড়ার প্রতি। তাই তিনি নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও এলাকার শিশুদের লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করেছেন। তার দেওয়া জমিতে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়টি এখন জাতীয়করণ হয়েছে। “আমি যহন শুনি আমার এই ইসকুলটি সরকারি হইয়া যাইবো তখন আমি খুবই খুশি হইসিলাম আর ভাবতেসিলাম হইতো এক সময় আমার এলাকার বাচ্চারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবো’’। বর্তমানে তারও ৩ জন ছেলেমেয়ে এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে।

নিজের এলাকাটিতে শিক্ষার আলো পৌছে দিতে শেখ দুলালের এই অবদানটি প্রকৃতপক্ষে প্রশংসার দাবিদার। নিজ স্বার্থকে ক্ষুদ্র মনে সমাজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে শেখ দুলাল প্রমাণ করে দিলেন যে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয়। তিনি ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে নিজ স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন শিক্ষার আলোয় গ্রামটিকে আলোকিত করতে। তার এই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। পাশাপাশি এলাকায় তিনি একটা নজির স্থাপন করেছেন।

happy wheels 2

Comments