প্রতিবন্ধকতা যেখানে বিদ্যমান আশা সেখানে শক্তিমান
সাতক্ষীরা থেকে মফিজুল ইসলাম
আশায় বাঁচে মানুষ। পৃথিবীতে প্রতিবন্ধকতার কোন শেষ নেই। লক্ষ্যে যে অনড় থাকে প্রতিবন্ধকতা তার কাছে তুচ্ছ। ভবিষ্যৎ সর্বদা অনিশ্চিত তাই বলে কি থেমে আছে মানুষ। গোছালো জীবন এলোমেল আর এলোমেল জীবন গোছালো এরই মাঝে ওপারে ডাক! অদ্ভূত এই চিরসত্য মেনে নিয়েই মানুষের বিচারণ। এরই মাঝে আশা বাঁচতে জাগায় নেশা।
বলছি, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের লবনগোলার বান্দলডাঙ্গা গ্রামের অধিবাসী মো. আলী হোসেনের কথা। পেশায় একজন দিনমজুর ছিলেন। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সাজালো গোছালো জীবন কাটছিল তাঁর। প্রতিদিন সকালে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ী হিসেবে কাজ করতেন শহরের বিভিন্ন জায়গায়। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে দেখতেন ছেলে,মেয়ে ও স্ত্রীর হাসি মুখ। কাজ থেকে ফিরার সময় ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর জন্য অল্প কিছু ভাজাভুজি নিয়ে ফিরতেন বাড়িতে। দিনমজুর হলেও অনেক আনন্দের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটছিল তার।
কিন্তুু হঠাৎ! জেংড়– রোগ কেড়ে নেয় তার ডান পা। জোগাড়ী কাজ করতে করতে সিমেন্ট লেগে লেগে ডান পায়ের বৃদ্ধা আঙুলে ছোট একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এটি সরু জেংড়–র মত দেখতে। একদিন রাতে ঘুমালে সকালে উঠে তিনি দেখে জেংড়– ফেটে গেছে। এ অবস্থায় মাঠে কাজ করতে যায়। তারপর থেকে ঘাঁ বাড়তে থাকে ও ইনফেকশনের সৃষ্টি হয়। প্রায় দুই মাস চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়েও ঘাঁ ভালো হয় না তাঁর। জানতে পারেন গ্যানগ্রীল হয়েছে। ডাক্তার পরামর্শ দেন পা কাটতে হবে। গ্যানগ্রীল ডান পায়ের টাকরুর একটু ওপর পর্যন্ত ধরা করে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সে পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। এতে অনেক টাকা খরচ হয়। তারপর মাস তিনেক একটু ভালো থাকলেও আবার একই অবস্থার সৃষ্টি হতে শুরু করে। তিনি বলেন, “ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আবারও ওষুধ খেতে শুরু করি। কিন্তু কোন ভালো ফল না পাওয়ায় আবারও হাটুর একটু নিচ পর্যন্ত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কেটে ফেলি। তাতেও অনেক টাকা খরচ হয়। প্রায় এক বছরের মত কোন কাজকর্ম করতে না পারার কারণে অনেক টাকা দেনা হয়ে পড়ি।”
তিনি আরও বলেন, “কিন্তু কি করবো! নিজেকে তো বাঁচতে হবে। ছেলেমেয়েকে তো মানুষের মত মানুষ করতে হবে। একই পা দুই দুইবার কেটে ফেলার পরও কোন উপকার হয়নি আমার ডান পায়ের। আবারও উরু পর্যন্ত কেটে ফেলার পরামর্শ দেয় ডাক্তার। বাধ্য হয়ে তিনবারের মত উরু পর্যন্ত কেটে ফেলি।”
কিন্তুু বাম পা তো ভালোই ছিলো তাই না আঙ্কেল, তাহলে বাম পাও কাটলেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, “কপাল খারাপ হলে কিছু করার নেই! এক পা নিয়ে তো লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে পারতাম। কিন্তুু ডান পায়ের শেষ অপারেশ করার পর দুই মাসের মাথায় বাম পায়ে অনেক ফোঁড়া হয়। ফোঁড়া থেকে ইনফেকশন হয়। অনেক চিকিৎসার পরও ভালো হয়নি। ভয় লাগত ডান পার মত বাম পা ও কেটে ফেলতে হয় কিনা! ঠিক তাই হলো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ২০১১ সালের দিকে বাম পা ও উরু পর্যন্ত কেটে ফেলি।”
তখন তাঁর মেয়েটা ক্লাস ওয়ানে পড়তো আর ছেলের বয়স দুই বছর হবে। স্ত্রী হাইপ্রেশার রোগী। এত কিছুর পরও তাঁর স্ত্রী তাঁর সর্বস্ব দিয়ে তাঁকে দেখছেন। এখন তিনি অনেক অসুস্থ। তিনি বলেন, “ভাবতে লাগলাম অনেক টাকা খরচ করার পরও দুই পা হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব প্রায়। বেঁচে থেকেও মৃত্যু। তবে মৃত্যু মানুষ কারো বোঝা হয় না, কিন্তুু আমি যেন এখন পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে গেছি। কিন্তুু আমি যখন সুস্থ ছিলাম তখন ছেলে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। তা এখন কি আর সম্ভব? কি করবো? একদমই বুঁঝে উঠতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে বেছে নিলাম সমাজের মানুষের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার ভিক্ষা নামক পেশাকে। কিন্তু কি করার ছেলেমেয়েকে তো মানুষ করতে হবে।”
তিনি বলতে থাকলেন, “এখন মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুলে ১৭০ জনের মধ্যে তার দুই রোল। সবাই বলে মেয়েটা অনেক মেধাবী। আর ছেলেটা ক্লাস ফোরে। ৬০ জনের মধ্যে তারও দুই রোল। আমার মেয়ের নাম শাকিলা আর ছেলের নাম সাকিব। শাকিলার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আর সাকিব হতে চায় শিক্ষক। কিন্তু কি করবো আমারও ইচ্ছা ছিলো ওদের দুইজনেরই আশা পূরণ করার। তবে এখন পারকতা নেই। নেই মাঠে কোন জমি। নিজের ১৮ কাঠা জমি ও একজনের কাছে বন্ধক রাখা। জানি না কখনো জমিটার বন্ধক ছাড়াতে পারবো কিনা!”
তাঁর স্ত্রীর শরীরটাও খুব একটা ভালো না। তিনি বলেন, “এখন প্রায় প্রায় হাইপ্রেশার রোগের কারণে বাড়িতে কান্ন্াকাটি পড়ে যায়। কখন না জানি সেও আমাকে ছেড়ে চলে যায়! একদিন শাকিলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে বাবা আমি অনেক পর্যন্ত পড়তে চায়, ডাক্তার হতে চায়। বাবা আরেকটা কথা তুমি আর ভিক্ষা করো না। আমার স্কুলের বন্ধু-বান্ধবীরা বলে ভিক্ষা না করে অন্য কিছু করতে। কিন্তু আমি ভিক্ষা ছাড়া কি করবো? এ অবস্থায় ধান কাটতি পারি, বিছলি বাঁধতে পারি। কেউ কি আমাকে জোনে নেয়?”
মো. আলী হোসেন বলেন, “প্রতিদিন বাড়ি থেকে সাতক্ষীরা মিশন মাদ্রাসার সামনে আসি সাহায্যের জন্য। এই দুটি ফিড়ি আছে। এখন এরাই আমার পা! এটি দিয়েই এক স্থান থেকে আর এক স্থানে যাওয়া আসা করি। ভ্যানটি অনেক কষ্টে কিনেছি ১১০০০ টাকা দিয়ে। যখন এ ভ্যানটি ছিলনা, তখন ভ্যানে করে সাতক্ষীরা মিশন মাদ্রাসার এখানে আসা যাওয়া করতে ৬০ টাকা খরচ হত। এজন্য অনেক কষ্ট করে ভ্যানটি কিনেছি।”
তিনি বলেন, “এখন কি আর করবো! তবে আমি আশা হত নয়। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমি নিজে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তারপর আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমার শাকিলা ও সাকিবকে ডাক্তার ও শিক্ষক হিসেবে দেখার জন্য তাদের পড়াশোনা চালু রাখবার জন্য আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও চেষ্টা করব।”