শিমের সাদা গোলাপী নীলাভ ফুলে কৃষকের চোখ
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
বেশি দাম পেতে আগাম জাতের শিম চাষে সব সময় তৎপর চাটমোহরের ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের হোগলবাড়িয়া গ্রামের শতাধিক কৃষক। তাইতো শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে পঁচা ভাদ্রেও ঘরে বসে না থেকে রোদ বৃষ্টির লুকোচুরির মাঝে শিম চাষের জন্য জমি প্রস্তত করতে থাকেন তারা। জমির মধ্যে তৈরি করেন উঁচু উঁচু ঢিবি। এর পর বীজ বপনের পালা। কয়েক দিনের মধ্যে মাটি ফুঁরে বেড় হয় চারা গাছ। লক লকে চারাগুলো বেড়ে উঠতে থাকে দ্রুত। বাড়তে থাকে কৃষকের পরিশ্রম। বাঁশ চিড়ে ছোট ছোট করে কেটে তার সাথে ‘জিআই তার’ বেঁধে বেঁধে উঁচু মাচা তৈরি করতে হয়। ফুল ঝরে যাওয়া, গাছের বৃদ্ধি, পচনের হাত থেকে রক্ষাসহ বিভিন্ন বালাই থেকে গাছকে রক্ষায় হরেক রকম বালাইনাশকের ব্যবহার করেন। মধ্য আশি^নের দিক থেকে পরিণত গাছ থেকে শিম আহরণ শুরু করেন তারা। সরেজমিনে শিম চাষীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, কিভাবে তারা দাঁড়াচ্ছেন মাথা উঁচু করে। পরিবর্তন করছেন ভাগ্যের।
আশরাফ মন্ডলের ছেলে মিলন গত বছর বারো কাঠা জমিতে অটো জাতের শিমের আবাদ করেছিলেন। হাজার পাঁচেক টাকা খরচ করে তিনি বত্রিশ হাজার টাকার শিম বিক্রি করেন। এ বছর দেড় বিঘা জমিতে শিম চাষ করেছেন। ফুলে ফুলে ভরে গেছে শিম গাছ। এ পর্যন্ত পঁচিশ হাজার টাকার মতো খরচ করেছেন। আশা করছেন, আশি হাজার টাকার শিম বিক্রি করতে পারবেন। মিলন বলেন, “অন্যান্য ফসলের চেয়ে শিমের আবাদে লাভ বেশি। এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে পচন লাগায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিম ক্ষেত। সীমিত আকারে শিম সংগ্রহ শুরু হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে সিম। এখন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার সাতশো থেকে দুই হাজার টাকা মণ। পাইকাররা জমিতে এসে নিয়ে যায়। আবার পাশর্^বর্তী গফুরাবাদ এলাকায় পাইকাররা থাকে। এরা শিম কিনে মুলাডুলির আড়তে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এ এলাকার শিম ট্রাক যোগে চলে যায় ঢাকা চট্রগাম সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়”।
অন্যের বাড়িতে কৃষিশ্রম বিক্রি করেন হোগলবাড়িয়া গ্রামের ইউনুস প্রাং এর ছেলে রিপন। স্ত্রী সন্তানসহ তিনজনের পরিবার পরিচালনা করেন তিনি। শিম চাষ করে অন্যদের লাভবান হতে দেখে এবার প্রথম তিনি বারো হাজার টাকায় এক বিঘা জমি কট (বন্ধক) নিয়েছেন। তিনি বলেন, “বর্ষণে জমিতে পানি উঠেছিল। এ পর্যন্ত বারো তেরো হাজার টাকা খরচ হয়েছে। শিম ওঠা শুরু হইছে। আশা করছি খরচ বাদে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ করতে পারবো”।
গত বছর দেড় বিঘা জমি লীজ নিয়ে শিম চাষ করে খরচ বাদে এক হাজার টাকা লাভ করেছিলেন হোগলবাড়িয়া গ্রামের আরজান মন্ডলের ছেলে আশরাফুল। গতবছর ভালো লাভ হওয়ায় এবার তিনি বিশ হাজার টাকায় দুই বিঘা জমি লীজ নিয়ে শিম চাষ করেছেন। দুই বিঘা শিমের জমির পেছনে এ পর্যন্ত বিশ হাজার টাকা খরচ করেছেন। আশরাফুল জানান, শিমের পুরো মৌসুম এখন। ঝড় বৃষ্টিতে দুই ঝাঁক শিম পঁচে পরে গেছে। এবার ভালো দাম পাচ্ছেন। আশা করছেন এবার এক লাখ টাকার মতো লাভ করবেন।
পাঁচ বছর যাবত শিমের আবাদ করে আসছেন একই গ্রামের জালাল প্রাং এর ছেলে ইউনুস আলী (৩৫)। এ বছর দেড় বিঘা জমিতে শিম চাষ করেছেন। ইউনুস আলী জানান, শিমের আবাদে প্রতিবছরই অন্যান্য আবাদের চেয়ে বেশি লাভ থাকে। এক বিঘা জমিতে পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকাও লাভ হয়। শিম গাছে যখন ফুল কলি আসে তখন ফুল বেছে দিলে শিম বেশি থাকে। ফুল ঝড়া রোধসহ বিভিন্ন বালাই থেকে শিম ও গাছ রক্ষায় বিভিন্ন রকম বালাইনাশক ও ভিটমিন স্প্রে করতে হয়। ঈশ^রদীর মুলাডুলিতে শিমের বৃহৎ বাজারে। সেখানে বিক্রি হয়ে থাকে এ এলাকার অধিকাংশ শিম।
গত বছর বারো কাঠা জমি শিম চাষ করে নয় দশ হাজার টাকা খরচ করে চল্লিশ হাজার টাকা লাভ করেন হোগল বাড়িয়া গ্রামের ইসমাইল হোসেন। এ বছর শিমের আবাদ বাড়ানোর ইচ্ছা থাকলে ও জমি লীজ পাননি তিনি। অবশেষে পনেরো হাজার টাকায় ৫ কাঠা জমি বন্ধক নিয়ে শিমের আবাদ করেছেন। তিনি জানান, কয়েক বছর শিম আবাদ করে সোয়া লাখ টাকায় অন্যের তিন বিঘা জমি বন্ধক রেখেছেন। তিন ছেলে মেয়েকে স্কুলে পড়ানোসহ পাঁচ জনের সংসার পরিচালনা করছেন। অবসর সময়ে অটো ভ্যান চালান। শিমের আবাদ এসে এখন আর কারো কাছে হাত পাততে হয় না তাকে।
দেড় বিঘা জমিতে শিমের আবাদ করেছেন হোগলবাড়িয়ার সাদেক আলী। পাঁচ বছর যাবত শিমের আবাদ করে আসছেন। তিনি বলেন, “শিমের আবাদ কর্যা দুড্যা পয়সা পাই। আল্লা কামাই দ্যায় জন্যি ধর্যা আছি। লোকসান হয় না। আমার কোনকিছু ছিল না। শিমের আবাদ কর্যা ছয় বিঘা জমি কিনছি। টিনির ঘর দিচ্ছি।”
মিলন, রিপন, আশরাফুল, ইউনুস, ইসমাইল, সাদেকই নয় এ গ্রামের শতাধিক কৃষক শিম উৎপাদনের সাথে জড়িত। অনেক অস্বচ্ছল পরিবার শিম চাষ করে স্বচ্ছল হচ্ছেন। অন্যদের শিম চাষ করে স্বচ্ছল হতে দেখে অনুপ্রাণীত হয়ে নতুন কৃষক যুক্ত হচ্ছেন শিম চাষের সাথে। তবে শিম খেতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বালাইনাশক করতে পারলে তবে এলাকায় উৎপাদিত শিম অধিক স্বাস্থ্যসম্মত হবে।
এ ব্যাপারে চাটমোহরে কর্মরত সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, চাটমোহরের হোগলবাড়িয়া, কাটাখালী, কামালপুর, মথুরাপুর ও ভাদ্রা এলাকায় বেশি শিম চাষ হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে একশ দশ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়েছে। আমরা ক্ষতিকর পোকামাকড় হাতে বেছে ফেলতে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি কৃষকদের নিমবিসাইড ও ডিটারজেন্ট পাউডার প্রয়োগের পরামর্শ দেই।