![করকোলা ঋষি পল্লীতে শিক্ষায় শিশুর ঝরে পড়ার হার কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2018/04/risi-polli-pic-2-604x345.jpg)
করকোলা ঋষি পল্লীতে শিক্ষায় শিশুর ঝরে পড়ার হার কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
যুগ যুগান্তর ধরে পাবনার চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের করকোলা গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ঋষি সম্প্রদায়ের বসবাস। মুসলমানদের পাশাপাশি এ গ্রামে বর্তমান ঋষি সম্প্রদায়ের ১শ’ ৫ পরিবার বসবাস করছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য গত ৪৭ বছরে লেখাপড়ায় অনগ্রসর এ ঋষি পল্লীর কেউই এসএসসি পাশ করতে পারেনি। এ পল্লীর মৃত খগেন্দ্র নাথ দাস ওরফে খোকা’র ছেলে ক্ষিতিস চন্দ্র দাস (৬৮) সর্ব শেষ ১৯৭০ সালে এসএসসি পাশ করেন। এরপর আর কেউ এসএসসি পাশ করেনি।
এ পল্লীর এক মাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি হওয়ায় নেতৃত্বে আছেন ক্ষিতিশ প্রধান। তিনি বলেন, “ব্রিটিশ আমল থেকে এ গ্রামে ঋষিদের বসবাস। ১৯৭০ সালে আমি মেট্রিক পাশ করি। এরপর আর কেউ মেট্রিক পাশ করেনি। এখন প্রায় সব শিশুই স্কুলে যায়। ফাইভ, সিক্স, সেভেন এসব ক্লাসে পড়ার সময় ঝরে পরছে তারা। বারো তেরো বছর বয়সে এসে কিশোররা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সেলুনের কাজ, জুতার কাজ, বেতের কাজ, দর্জির কাজসহ এরুপ বিভিন্ন কাজে লিপ্ত হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “কেউ কেউ দোকান পাটের কর্মচারী হচ্ছে। মেয়েরা মায়েদের সাথে বাঁশের কুটির শিল্পের কাজে লিপ্ত হচ্ছে। মেয়েদের অপেক্ষাকৃত কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মূলত অভিভাবকদের অসচেতনতা ও অর্থের অভাবে তারা আর পড়ালেখা করছে না। বর্তমান এ পল্লীতে ৬০ থেকে ৭০ জন স্কুল গমনোপযোগি ছেলে মেয়ে রয়েছে। এরা স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মন্দির ভিত্তিক শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও পাশের স্কুল গুলোতে পড়ালেখা করছে। অনেকেই পড়ালেখা শুরু করে কিন্তু কেউই টিকে থাকে না পড়া লেখায়।”
নর সুন্দর পেশায় নিয়োজিত এ গ্রামের নগেন চন্দ্র দাসের ছেলে শ্রীপদ দাস (৩৭) বলেন, “নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে এখন চাটমোহর-মান্নাননগর সড়কের কুজোর মোড় এলাকায় সেলুন করেছি। আমাদের ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেলেও কর্ম করার উপযোগি হলে সবাই কর্মে ঢুকছে। কেউ বেশি পড়া লেখা করছে না। মেয়েদেরকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকেরা। কিছু নারী দর্জির কাজ ও কুটির শিল্পের কাজ করেন। ছেলেদের বেশির ভাগই নর সুন্দর পেশায় সম্পৃক্ত হয়।” নর সুন্দর পেশায় কর্মরত ষষ্ঠ শ্রেণী পাশ মানিক চন্দ্র দাস (২৮) বলেন, “এটা আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমরা পড়ালেখায় অগ্রসর হতে পারিনি। তাই আমাদের কেউ কোথাও কোন চাকরি বাকরিও করছে না। বছরের পর বছর আমাদের পূর্ব পুরুষদের মতো আমরাও পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটছে না।”
অত্যন্ত ঘন বসতি পূর্ণ এলাকা করকোলা ঋষি পল্লী। ৬ বিঘার মতো জমিতে ১শ’ ৫ পরিবার গাদা গাদি করে বসবাস করছে কোনমতে। পল্লীর প্রায় চার পাশেই খাল। দক্ষিণ পাশে কাঁচা মাটির রাস্তা। রাস্তায় ওঠার জন্য সম্প্রতি পূর্ব উত্তর পাশের খালের উপর স্থানীয় চেয়ারম্যান কালভার্ট করে দিয়েছেন। কেউ এক শতক কেউ দুই শতক এরকম পরিমাণ জায়গার উপর বাড়ি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। মাঠে কারো কোন জমা জমি নাই। জমি চাষ করেন না কেউই। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কিছুদিন পূর্বে ঋষি পল্লীর জন্য একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করে দিয়েছেন। এখন কমিউনিটির মিটিং হয় এ সেন্টারে। কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই অবস্থিত দক্ষিনেশ^র কালী মন্দির। এখানেই কালী পূজা, দূর্গা পূজা, মহাদেব পূজা, স্বরস্বতী পূজাসহ অন্যান্য পূজা অর্চনার কাজ সারেন ঋষি পল্লীর নারী পুরুষ। বারুণীর গঙ্গা স্নান অনুষ্ঠিত হয় এ ঋষি পল্লীর একটু দূর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার শাখা নদী গুমানীতে। গঙ্গা স্নানের দিন করকোলা ঋষি পল্লীতে লাগে উৎসবের আমেজ। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে এদের জীবনমান উন্নয়নে কিছুদিন পূর্বে লালন পালনের উদ্দেশ্যে ২০টি গরু দেয়া হয়। গৃহ নির্মাণের জন্য এ পল্লীর ৪৬ জনকে ১৮ হাজার করে টাকাও দেয়া হয়। বিতরণ করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ।
যুগ পাল্টেছে। ত্রিশ চল্লিশ বছর পূর্বে এ ঋষি পল্লীর অনেকে নদী পথে ভেসে আসা গরু ছাগল ভেড়ার চামড়া ছড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতো। এখন মানুষ সচেতন হওয়ায় পরিবেশের সুরক্ষায় মৃত পশু খুব একটা নদীতে ভাসিয়ে না দিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখে। এদের অনেকে বেতের কাজ করলেও বেতের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় এ কর্মেও তারা টিকতে পারেনি। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে এমন প্রবাদ প্রবচন এ ঋষি পল্লীর বেলায় যেন প্রযোজ্য নয়। পাগল না হলেও এরা নিজের ভালো নিজে বোঝে বলে মনে হয়না। যদি বুঝতো তবে কেউ না কেউ ছেলে মেয়েদের পড়াশনা করাতো। এ পল্লীর শত ভাগ শিক্ষার্থী যখন ঝরে পরছে তখন এদের কাউন্সিলিং ও প্রয়োজনে বাড়তি সুযোগ সুবিধা দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে উৎসাহ যোগানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার অসীম কুমার বলেন, “উপজেলার মধ্যকার একটি ঋষি পল্লী শিক্ষায় এতটা পিছিয়ে রয়েছে বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সাথে কথা বলে প্রয়োজনে অতিরিক্ত নজরদারী করা হবে। কেন এ পল্লীর শিশুরা লেখাপড়ায় ঝরে পরছে তার কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে এ শিশুদের জন্য পৃথক ডাটাবেজ তৈরি করে আলাদা যত্ন নেওয়া হবে।”
এ প্রসঙ্গে পাবনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুস সালাম বলেন, “৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের ৫ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। এ ব্যাপারে উক্ত এলাকার প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঝরে পরা রোধ কল্পে প্রয়োজনে অতিরিক্ত হোম ভিজিট, অভিভাবক সমাবেশ এবং অভিভাবকদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করে শিক্ষার্থী ঝরে পরা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।