ঔষধি গুণে ভরপুর দুধসাগর
তানোর, রাজশাহী থেকে অনিতা বর্মণ
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার পৌরসভায় অবস্থিত হরিদেবপুর গ্রামের মো. মোবারক আলী (৬৫) পেশায় একজন কৃষক। পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন জন। ৫ বিঘা বর্গা জমিতে সারাবছর ধান, সরিষা, আলু, পেঁয়াজও রসুন চাষ করে সংসারে চালান। বসতবাড়িতে বৈচিত্র্যময় ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছ রোপণ করেন। এসব গাছের মধ্যে দুধসাগর গাছটিও রয়েছে।
মো. মোবারক আলী বলেন, “চার বছর আগে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে এই দুধসাগর গাছটি সংগ্রহ করে এনে আমার বাড়িতে লাগাই। এই গাছের ডাল লাগানোর ১০/১৫ দিনের মধ্যেই এই গাছের কুশি গজায়। তবে এই গাছের মরণ নাই।” তিনি আরও বলেন, “এই গাছটির পুরো শরীর যেন সাদা তরল পদার্থ বা দুধে ভরপুর। গাছটির যে কোন জায়গায় একটু চিমটি দিলেই সাদা তরল আঠালো রস বের হয়ে আসে। আর এই জন্য গাছটির নাম দুধসারগ।” তবে কেউ কেউ এর নাম দেন দুধস্বর। সাধারণত বরেন্দ্র অঞ্চলের যে কোন শুষ্ক বা আর্দ্র বেলে দো-আঁশ মাটি, রোদ বা ছায়াযুক্ত, স্যাঁতস্যাঁতে সব ধরনের মাটিতেই দুধসাগর গাছটি জন্মায় বলে জানান মোবারক আলী।
দুধসাগর গাছটি ডাটাযুক্ত, গাছটির উচ্চতা সাধারণত ৮/১০ ফুট লম্বা, গাছটির আকৃতি ঝোপ জাতীয়, এই গাছের কোন পাতা নেই, তবে গাছটির গায়ের আবরণ একটু খসখসে, গাছটির শাখাপ্রশাখাগুলো ঘন সবুজ রঙের । এই গাছে কোন প্রকার ফুল বা ফল দেখা যায় না । এই গাছের ডাটাগুলোর অগ্রভাগ ঝোপ প্রকৃতির হয়ে থাকে। দুধসাগর গাছের ডাটাগুলো এক প্রকারের গন্ধ আছে, আর এই গন্ধের কারণে গরু -ছাগল সহজে নষ্ট করতে পারে না। গাছটির গোড়া বা শিকড় মাটির গভীরে থাকে। গাছটি ডাল বছরের যে কোন সময় লাগানো যায়। এই গাছটি লাগানোর জন্য নিদির্ষ্ট কোন জায়গায় লাগে না, বাড়ির আশেপাশে বা পুকুর পাড়ে লাগানো যায়। গাছটির ডাল লাগানোর ১০/১৫ দিনের মধ্যেই ডালে কুশি গজায়। গাছটির বাড়ন্ত এমন যে বছরে দুই বার ডাল ছেঁটে দিতে হয় ।
দুধসাগর গাছের কিছু ওষুধি গুণাগুণ সর্ম্পকে মো. মোবারক আলী বলেন, “আমাদের এলাকায় কম বেশি সবাই গরু-ছাগল পালন করে থাকেন, আর এই গৃহপালিত পশুগুলোর অনেক সময় দুধজ্বর, দুধহীনতা ও ওলান ফুলে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়। আর এই সমস্যা সমাধানে দুধসাগর গাছ ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।” তবে গবাদি পশুর দুধহীনা সমস্যাতেই এই গাছের ব্যবহার বেশি বলে মনে করেন তিনি। কোন সমস্যার ক্ষেত্রে এই গাছ খাওয়ানো সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই গাছের কচি ডালগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে খড়ের সাথে একত্রে মিশে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া এই গাছের ডাটা টুকরো করে কেটে বাঁেশর পাতা, কলা পাতার সাথে জড়িয়ে খাওয়াতে হবে। তবে এই গাছ খাওয়ার নিদির্ষ্ট সময় হচ্ছে রবিবার সকালে বাশি পেটে খাওয়ালে বেশি উপকার পাওয়া যায়।”
গবাদি পশুর উপকারের পাশাপাশি এই গাছ মানুষেরও উপকারে আসে। এ সম্পর্কে একই গ্রামের মোছাঃ কবুলজান বেগম বলেন,“মানুষের জন্য এই গাছটি ওষুধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের গ্রাম অঞ্চলে অনেক মায়ের ও দুধের ঘাটটি দেখা যায়, আর সেই সময় বাচ্চারা সঠিকভাবে দুধ পায় না। তখন তাদের বাজার থেকে কিনে দুধ খাওয়াতে হয়। কিন্তু অনেক পরিবার আছে বাজার থেকে কেনার সামর্থ্য নেই, তখন তারা এই দুধসাগর গাছটি রান্না করে খেয়ে থাকেন। শিং, মাগুর, কৈ, ফলি, টাঁকি মাছ এর সাথে এই গাছের কচি ডাটাগুলো টুকরো করে কেটে রান্না করে ঝোলগুলো খেলে মায়ের দুধের ঘাটটি পূরণ হয়।” চলতি মাসে একই গ্রামের মোছাঃ বুলবুলি বেগম (৩০) নিজে ব্যবহারের জন্য এই গাছের ডাল সংগ্রহ করে উপকার পেয়ছেন বলে জানান।
মো. মোবারক হোসেন জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ২০/২৫ জন নারীকে এই গাছের ডাটা সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে দেখেছেন। চলতি বছরে পাশ্ববর্তী গ্রাম ও নিজ গ্রামের প্রায় ৩০ জন মানুষ এই গাছের ডাল নিয়েছেন লাগানোর জন্য। এই গাছ দিয়ে যে এতো মানুষের উপকার করতে পারবেন তা কখনো ভাবতে পারেননি।
তবে এখনো অনেক মানুষ আছে এই গাছের উপকারিতা সর্ম্পকে জানেনা। এই গাছ থেকে মানুষসহ গৃহপালিত পশুর উপকার হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে এই গাছ লাগানোর দরকার। তবেই এই গাছটি টিকে থাকবে ।