হারিয়ে যেতে বসেছে সুস্বাদু নোনা
সাতক্ষীরা থেকে নুরুল হুদা
নোনা ফল। এটি আতা ফলের গোত্রভুক্ত। শহরের মানুষ আতা ও নোনাকে প্রায় ঘুলিয়ে ফেলেন। গ্রামাঞ্চলের ঝোপ-ঝাড়ে বেড়ে ওঠা নোনার ভেতরে সাদা শাসযুক্ত বিচি থাকে। খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এর শাঁসে বালির মতো একটা ভাব থাকে। যেটা আতায় থাকে না। কাচা অবস্থায় সুবজ হলেও পাকলে এটি বাদামি রঙ ধারণ করে।
গ্রামে বাড়ির উঠোনে কিংবা বনে-জঙ্গলে নোনা গাছের কদাচিৎ দেখা মেলে। বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে আতা বা নোনা ফলের ঐতিহ্য। আমাদের ফলের তলিকায় আম, কাঁঠাল, লিচু, আপেলের ভিড়ে পিছিয়ে পড়েছে নোনা ফল। তাই এখন শুধু বইয়ের পাতায় বা ছবিতেই এ ফল দেখা যায়। নোনা দিয়ে যে সুস্বাদু পায়েস তৈরি করা যায় এটি অনেকেরই অজানা।
নোনা গাছ সাধারণত ৩০-৩৫ ফুট হয়ে থাকে। আমেরিকা মহাদেশে কোনো কোনো গাছ সর্বোচ্চ ৪০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই গাছের বাকল ধূসর বর্ণের হয়। কাঠও বেশ নরম হয়। এর পাতা ৫-৮ ইঞ্চি লম্বা এবং প্রস্থে ২ ইঞ্চি হয়। পাতাগুলোর অগ্রভাগ সরু হয়।
নোনা গাছের দুই তিনটা ফুল একত্রে জন্মে। ফুলগুলো ১ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা হয়। আতার ফুলে পাপড়ি থাকে ৩টি। কিন্তু পুংকেশর সংখ্যা থাকে অনেক। কিন্তু পুংকেশরে তুলনায় পাপড়িগুলো বেশ বড় হয়ে থাকে। ফলে ফুলগুলো লম্বাটে দেখায়। নোনা গাছে ফুল আসে মার্চ এপ্রিল মাসে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এর ফল হয়। ফলগুলো প্রায় গোলাকার ২ থেকে ৪ ইঞ্চি ব্যাসের শাঁসযুক্ত হয়।
ফলের বাইরে ত্বক বেশ পুরু। ফলের ত্বকের বাইরে দিকটা দেখে মনে হয়, ছোটো ছোটো খণ্ডে বিভক্ত। তবে আতার মতো এই বিভাজন অতোটা স্পষ্ট নয়। ফলের ভিতরে বোঁটা কিছুটা প্রবিষ্ট থাকে। এই দণ্ডের বাইরে ছোটো ফলের কোয়া দেখা যায়। প্রতিটি কোয়ার ভিতরে কালচে বিচি থাকে। মূলত এই বিচি ঘিরে থাকা শাঁসালো অংশই মানুষ, পাখি খেয়ে থাকে। ফলগুলো বেশ মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়।
এখন নোনা পাকার সময়। মৌসুমী ফল হিসেবে বাজারে এখন সহজলভ্য হওয়ার কথা এটি কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। শহরের পাকাপুল, টাউন বাজার ও ডে নাইট কলেজ মোড় ছাড়া আর কোথাও মিলছে না এ ফলটি। তাই বাজারে ফলের দামও বেশ চড়া। বড় সাইজের প্রতিকেজি নোনা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। মাঝারি ও ছোট সাইজের নোনা বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৮০ টাকা।
ডে নাইট কলেজ মোড়ে নোনা ক্রেতা আলমগীর হোসেন বলেন, “নোনায় প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে। রসালো সুস্বাদু এই ফল খেতেও দারুণ লাগে। ছোট বেলায় বাড়িতে গাছ ছিল নোনা খাওয়া হতো কিন্তু এখন শহরে বাস করায় কিনে খেতে হয়।”
পাকাপুলের উপরের এক নোনা বিক্রেতা বলেন, “নোনা অপ্রচলিত দেশি ফল। শহরে বেশ নোনার চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এখন নোনা দূর দূরন্ত থেকে কিনতে হয় তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। নোনা দুই তিন দিনের বেশি ভালো রাখা যায় না। নষ্ট হয়ে যায়। তাই বিক্রি না হলে লোকসানের সম্ভবনা থাকে। নোনা বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হওয়ায় বাজারে তুলনামূলক দাম বেশি।”
তিনি আরও বলেন, “দূর থেকে নোনা পাইকারী কিনে আনতে হয়। তাই আনতে আনতে অনেক ফল পচে যায়। ফলে নোনার দাম বেশি পড়ে যায়। প্রতি কেজি পাইকারি দাম ১৩০-১৬০টাকা পড়ে। সাথে পরিবহন খরচ তো রয়েছেই।”
মুক্তকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, নোনা Annonaceae গোত্রের আতার ন্যায় গাছ ও তার ফল। এর আদি নিবাস আমেরিকা মহাদেশের উষ্ণস্থানে। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমারে এই গাছ পাওয়া যায়। এর ইংরেজি নাম custard-apple, bullock’s heart বা bull’s heart। এর বৈজ্ঞানিক নাম Annona reticulata।
ভারতীয় বনৌষধি বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে পাওয়া যায়, নোনা আমাশয় নিবারণ করে এবং ক্রিমি ধ্বংস করে। নোনার দানা বিষাক্ত। স্বল্প মাত্রায় মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়। নোনার পাতা ক্রিমিনাশক হিসেবে কাজ করে।