সম্পদের পাশাপাশি সমাজে নারীদের বাধাগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আইলা
সুন্দরবনের কোলঘেঁষে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম দাঁতিনাখালী। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের এই গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ারা খাতুন, সেলিনা পারভীন, নুরভানু, শেফালী আক্তারসহ বেশ কিছু বনজীবী নারী। তাদের সাথে আলাপচারিতায় এলাকার নারীদের আবস্থা ও অবস্থান, সংসার ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকা, নারীদের আয়ের উৎস, নারীর স্বাভাবিক চলাচলে বাধার বিষয়সমূহ, মজুরি বৈষম্য, সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা এবং নারীদের এগিয়ে চলার গল্পসহ নারী ও সুন্দবনকে বাঁচানোর বয়ান এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের সাথে কথপোকথনের চুম্বক অংশগুলো পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন এরশাদ আলী:
বারসিক নিউজ: কেমন আছেন আপনারা?
বনজীবী নারীরা : খুব একটা ভালো নেই ভাই। আমরা নারীরা আরো বেশি খারাপ অবস্থায় আছি। আমাদের গ্রামে যাওবা একটু অবস্থান আছে শুনেছি বাইরে নারীর অবস্থান আরও খারাপ। এই যে ধরেন, আমরা নারীরা বিভিন্ন সময় বন থেকে কাঁকড়া ধরি। কাঁকড়াগুলো গ্রেড অনুযায়ী বিক্রি হয়। দেখেন এখানে একটি বিষয় নারী কাঁকড়ার বাজার দর সবচেয়ে বেশি পুরুষ কাঁকড়ার থেকে। দূঃখ লাগে একটাই আমাদের মানব সমাজেই শুধুমাত্র নারী জাতির কোন দাম নাই। মানুষ ছাড়া আমার মনে অন্য সকল ক্ষেত্রেই নারীদের বেশি দাম দেয়া হয়।
বারসিক নিউজ: আপনারা সংসার চালানোর জন্য কি কি কাজ করেন?
বনজীবী নারীরা: উপস্থিত বনজীবী নারীদের মধ্য থেকে মনোয়ারা খাতুন বলছিলেন, স্বামী যখন আমার সাথে ছিল আমি তখনও কাজ করতাম তবে পুরো সংসার চালানোর জন্য কাজ করা লাগতো না। আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন। বর্তমানে পুরো সংসার আমার উপরে। আমি কাজ না করলে সবাই না খেয়ে থাকে। আমার দায়িত্ব অনেক। মনোয়ারা খাতুনের সাথে তাল মিলিয়ে অন্যরা বললেন, বর্তমানে আমাদের সংসারের আয়ের উৎস আমরা এবং আমাদের সুন্দরবন। যখন পরিস্থিতি ভালো থাকে তখন আমরা সুন্দরবনে গিয়ে কাঁকড়া ধরি, মাছ ধরি, মাছের পোনা ধরি, গোলপাতার মৌসুমে সময়গুলোতে গোলপাতা সংগ্রহ করি, কেওড়ার ফল সংগ্রহ করি। এছাড়া অন্য সময়ে বিশেষ করে যখন সুন্দরবনে আমরা ঢুকতে পারি না, তখন অন্যের বাড়িতে জোন (শ্রম) দিই। জোনের কাজ না থাকলে অন্যের বাড়িতে ছুটা (ফরমায়েশী) কাজ করি যেমন থালা বাসন ধুয়ে দেওয়া, ঘড় লেপে দেওয়া প্রভৃতি।
বারসিক নিউজ: বাইরে কাজের ক্ষেত্রে নারীদের প্রধান বাধা কি বলে আপনি মনে করেন?
বনজীবী নারীরা: প্রতিনিয়ত আমাদের মতো নারীদের বাইরে কাজ করতে হয়। একই সাথে নারী পুরুষ সকলকেই কাজ করতে হয়। নারী পুরুষ একসাথে কাজ করা বা অন্যের বাড়িতে কাজ করতে গেলে এক ধরনের মানসিক চাপ কাজ করে। আপনারাও জানেন আমরাও জানি সুন্দরবনে ঢোকা এখন নিষেধ আছে। এরপরেও আমরা চুরি করে কাজ করে থাকি। যখন বনের লোকজন বা ডাকাত ধাওয়া করে তখন একজন পুরুষ যত সহজে দৌড়ে চলে আসতে পারে আমরা নারীরা তত সহজে পারি না। আমাদের কাপড় ডালে বেঁধে বেশিরভাগ সময় পড়ে যাই। ফলে দেখা যাচ্ছে কোন কোন সময় অন্যের কাছে অপদস্থ হতে হয়। নারীদের পোশাক আমার মনে হয় তাদের সকল কাজের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। আবার অন্যের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে একই কাজ একজন পুরুষ যখন করছে তখন কোন সমস্যা হচ্ছে না। তাদের কখনই কোন খাদ ধরছে না। কিন্তু ঐ একই কাজ একজন নারী যখন করতে যাচ্ছে তখন সবাই বলছে এই এটা এমন হলো কেন। এটা এতো দেরি হচ্ছে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মনে হয় নারীদের সমাজে অবস্থান নাই বলে এইগুলো বলার সাহস পাচ্ছে সবাই। কারণ সবাই নারীদের সবসময় দূর্বল ভাবে।
বারসিক নিউজ: আপনার গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা নারীদের কি চোখে দেখে?
বনজীবী নারীরা: আমাদের গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা এখন পরিবর্তনের পথে আছে। সমাজ ব্যবস্থা বর্তমানে নারীদেরকে অবমূল্যায়ন কম করছে। তারা যে পরিশ্রম করে টাকা আয় করছে। সেই টাকা দিয়ে যে সংসার চালাচ্ছে তাতে সমাজ কোনদিন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। তবে গ্রামের বাইরে অন্য শহরে কাজ করে ফিরে আসলে তখন নারীদেরকে একটু খারাপ দৃষ্টিতে ভাবতে থাকে সমাজ। গ্রাম বা সুন্দরবন এলাকার বাইরে সংসার চালানোর তাগিদে কোন নারী যদি কাজ করতে যায় তা গ্রামবাসী ভালো চোখে দেখে না। গ্রামবাসী মনে করছে বাইরে কোন নারী কাজ করতে গেলে তার চরিত্র ভালো থাকে না। কিন্তু এলাকার মধ্যে আমরা যখন কাজ করছি তখন সমাজের কাছ থেকে এই ধরনের কোন সমস্যা হয় না।
বারসিক নিউজ: একজন নারী হিসেবে সংসারের হাল ধরেছেন তাতে করে আপনারা কি সফল বলে মনে করেন?
বনজীবী নারীগণ: আমরা যারা নিজের আয়ে সংসার চালাই তাদের কষ্ট করাটা সফল হচ্ছে। আমরা স্বামীকে ছাড়া নিজেই সফলভাবে কাজগুলো করে যাচ্ছি। আমাদের আরো ভালো লাগে যখন দেখি আমাদের দেখাদেখি এই গ্রামের আরো অনেকে নিজের মতো করে তাদের সংসার চালায়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। আমাদের কাছে বিভিন্ন সময় এসে তারা চিন্তা সহযোগিতা নিচ্ছে। আমরা তাদের বোঝাচ্ছি স্বামী থাকে না তো কি হয়েছে আমাদের হাত পা তো আছে। নিজেরা তো মারা যাই নাই। আমরাই পারবো আমাদের সংসারকে নিজ হাতে চালিয়ে নিতে। আর স্বামীর উপর নির্ভর না করে নিজেই যদি সবাই সংসার চালাতে সক্ষম হই তবে তো আর কেউই নির্যাতনের শিকার হয় না। আমরা মনে করি, যত নির্ভরশীলতা তৈরি হবে ততই আমরা নারীরা সমাজে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না।
বারসিক নিউজ: নারীর মজুরী বৈষম্য নিয়ে আপনারা কিছু বলতে চান?
বনজীবী নারীগণ: সারাদেশের মতো আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের এলাকাতেও মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। আমরা নারীরা যখন কোন কাজ করি সেখানে আমাদের সাথে পুরুষরাও কাজ করে। তারা আমাদের সম্মান দেয় তবে মজুরি সমান দেয় না। যেমন ধরেন ঘেড় এ কাজ করতে গেলে সারাদিন কাজ শেষে একজন নারী পাচ্ছে মাত্র ১৫০ টাকা অন্যদিকে পুরুষরা পাচ্ছে ২০০ টাকা। কিন্তু আমার মনে হয় নারীরা পুরুষের সমপরিমান বা কোন কোন সময় বেশি কাজ করেন। আমরা মালিক পক্ষকে বলেছি টাকা সমান দেবার জন্য। তারা বলে হ্যাঁ আমরা দেখছি তোমরা সবাই সমান কাজই করছো তবে এটা যেহেতু প্রচলিত সেহেতু আমারা পরিবর্তন করতে পারবো না। তবে সমান মজুরির ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে আমাদের এলাকায়। কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রজেক্ট চালু হয়েছে। সেখানেই কেবলমাত্র নারী পুরুষ সবাইকে সমান মজুরি দেওয়া শুরু করেছে। আমার দাবি এই রকম যদি আরো কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সমান মজুরি দেওয়া শুরু করে তবে পরিস্থিতি সহজেই পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি। আমরা আশা করি সেই সমান মজুরির সমাজ আসতে আর বেশি দেরি নয়।
বারসিক নিউজ: এবার সুন্দরবন সম্পর্কে আপনারা কিছু বলুন?
বনজীবী নারীগণ: কি আর বলবো ভাই! সুন্দরবন এর ভেতরে একবারে ফাঁকা মাঠ হয়ে গেছে। চারিদিকে দেওয়ালের মতো গাছগুলো শুধুমাত্র আছে। সুন্দরবন আমাদের মা। আমরা মানুষ জাতি যেভাবে নারীদেরকে সম্মান না দিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের শোষণ করে দিনের পর দিন ধ্বংস করে দিচ্ছি। ঠিক একইভাবে আমাদের মনে হয় আমরা মানুষ জাতিও আমাদের মা সুন্দরবনকে দিনে দিনে ধ্বংস করে ফেলছি।
বারসিক নিউজ: সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য সরকারের উদ্যোগুলো আপনারা মানছেন না কেন?
বনজীবী নারীগণ: সরকার যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেই সব আমার মাকে বাঁচানোর জন্যই করছে। তবে সরকারে এটাও ভাবা উচিত ছিল যে আমরা কেন নিষেধ স্বত্বেও সুন্দরবনে যাচ্ছি। একসময় আমাদের কাজের কোন অভাব ছিল না। সুন্দরবন থেকে কোন কিছু সংগ্রহ করতে না পারলেও বছরের প্রায় ৫ থেকে ৬ মাসের আয় আসতো গাঁও গ্রামের কাজ থেকে। ঘেড় ব্যবস্থা আমাদের কাজগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ঘেড়ের ফলে দেশের আয় হচ্ছে কিন্তু আমাদের কাজ কমে গেছে। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও আমারা ধানের জমি থেকে ধান কুড়িয়ে, জমিতে কাজ করে, ঘাস বেছে, ধানের কূড়া সংগ্রহ করে, কৃষাণের বাড়িতে ধান মাড়াই করে ৫ থেকে ৬ মাসে খাদ্যেও নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতাম। ঘেড়ের জমিতে শ্রমিক লাগে অল্প। যেখানে এক বিঘা জমিতে ৫ জন শ্রমিক খাটতো সেখানে বর্তমানে ঘেড়ের জমিতে মাত্র একজন হলেই চলে। ঘের আমাদের বিশেষ করে নারীদের হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়েছে। গাঁও গেরামের কাজও নাই আবার সরকার সুন্দরবনে ঢুকতে না দিলে আমরা খাবো কি। পরিবার পরিজন বাঁচবে কি করে?
বারসিক নিউজ: সুন্দরবনকে ঠিক রাখবার জন্য আপনাদের নিজস্ব ভাবনা কি ?
বনজীবী নারীগণ: সুন্দরবন একজন নারী, একজন মা। এই মাকে বাঁচাতে হলে, তাকে তার আগের মর্যাদায় ফিরায়ে আনতে চাইলে সংশ্লিষ্টদের কিছু কাজ করতে হবে। এই মাকে কেন্দ্র করে আমরা যারা টিকে থাকি তাদের জন্য আলাদা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা কারো কাছে বলতাম না যে আমাদের কাজ দেন। তবে যেহেতু আমাদের কাজের জায়গা অন্যরা ধ্বংস করেছে। তাই অন্যকেই আমাদের কাজের নিশ্চয়তা করতে হবে।
বারসিক নিউজ: বর্তমানে নারীদের ঘরে-বাইরে বিভিন্ন কাজে যে অংশগ্রহণ বাড়ছে সে সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি?
বনজীবী নারীগণ: আজ থেকে ১০ বছর আগেও আমাদের সমাজের নারীরা ঘরের বাইরে যেত না। বর্তমানে এই ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। বিভিন্ন এনজিওদের কার্যক্রম, উৎসাহ ও সচেতনতার পাশাপাশি পরিবারের আয়ের উৎস কমে যাওয়ার কারণে নারীরা ঘরের বাইরে আজ নিজেদের নিয়োজিত করেছে। আমার মনে হয় এই দুটো কারণে নারীরা বর্তমানে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া শুরু করছে।
বারসিক নিউজ: সবাই বলে আইলার পরে নারীদের বাইরের কাজে অংশগ্রহণ বেড়েছে, আপনারা এই বিষয়ে কি মনে করেন?
বনজীবী নারীগণ: এটা ঠিক আইলার পরে বিভিন্ন কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। আসলে আইলা সব সম্পদ ভাসায়ে নেওয়ার পাশাপাশি সমাজের নারীর জন্য বাধাগুলোও ভাসায়ে নিয়ে গেছে। আইলার পরে সংসারে যে আর্থিক কষ্ট তৈরি হয়েছিল তা স্বামীর পক্ষে একলা সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ায় স্ত্রীরা আর ঘরে বসে থাকতে পারে নাই। তারাও স্বামীর পাশাপাশি বাইরে অর্থ উপার্জনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। আইলা পরবর্তী সংসার ব্যবস্থাপনাতেও ব্যাপক একটা পরিবর্তন বর্তমানে দেখা যাচ্ছে। স্বামী বেঁচে থাকলেও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে নারীরাই সংসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে। এমনকি স্বামীকে ডাকাতে ধরলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা। এককথায় আর্থিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার সকল বিষয় বর্তমানে নারীরা দেখভাল করছে।
বারসিক নিউজ: নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ কি?
বনজীবী নারীগণ: আমরা যারা নারীরা কোন কাজকর্ম না করে আমাদের স্বামীর উপর নির্ভর করে দিন অতিবাহিত করছি এবং যাদের স্বামী বা অর্থ উপার্জনের কেউ নেই তারাও বসে না থেকে নিজে নিজে কাজ করতে হবে। আমার মনে হয় নারীদেরও আর্থিক জায়গা শক্তিশালী হলেই কেবলমাত্র অন্য সকল মুক্তি সম্ভব। তাই বাংলাদেশের সকল নারীদেরকে বলবো আপনারা আগে নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করুন। নারীরা পারে না, নারীদের দিয়ে হবে না এমন ভাবনা বাদ দিয়ে একধরনের জেদ নিজের মধ্যে নিয়ে আসুন।
বারসিক নিউজ: আপনাদের ধন্যবাদ, সকলের জন্য কিছু বলবেন কি?
বনজীবী নারীগণ: আপনাদেরও ধন্যবাদ। সকলের উদ্দ্যেশে আমাদের শেষ কথা হলো, আমাদের মা, একজন নারী অথবা একটি সুন্দরবনকে নিজের মতো থাকতে দিন। নিজেকে নিজ হাতে তার সংসারকে চালাতে দিন। এখানে উপর থেকে কোন বিষয় চাপিয়ে দিবেন না। সবাই মনে রাখবেন আমার মা যদি মারা যায় তবে মাতৃছায়া যে কি জিনিস তার অভাব তখন বুঝতে পারবেন।