‘মা-বাবার ওপরে কোন পীর নাই; তাদের সেবা করেন’-বাউল আবুল হোসেন
মানিকগঞ্জ থেকে শুকুফে ইসলাম
কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাদেরকে বলা হয় “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” প্রকৃতির। এরা তথাকথিত পথে চলেন না। সংসার ধর্মের প্রতিও আকর্ষণ থাকে কম। অনেকের ক্ষেত্রে নেই বললেও চলে। এঁদের চিন্তা-চেতনা, জীবন সম্পর্কে মূল্যায়ন থাকে সম্পূর্ণ আলাদা। জাগতিক বৈষয়িক মোহ থেকে যেন পালিয়ে বেড়ান তাঁরা। মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর অঞ্চলের সাইলকাই গ্রামের আবুল হোসেন তেমনই একজন মানুষ। বয়স ৬৪ বছরের মতো হবে। পেশায় একজন কৃষক হলেও, মনের দিক থেকে তিনি একজন বাউল। সাইলকাই গ্রামের পাশের একটি বাজার, বাঙালা বাজারে দেখা হয় তাঁর সাথে। কেমন আছেন, জিজ্ঞাসা করতে এক গাল হেসে বলেন, “দয়ালে যেমন রাখছে। ভালো আছি।” একটা টং দোকানের বেঞ্চে বসে গল্প শুরু হয় কাঁচাপাকা ঝাঁকরা চুল আর শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রু বিশিষ্ট সদা হাসোজ্বল মানুষটির সাথে।
খুব ছোটবেলা থেকেই বাউলিয়ানা ঢুকে গিয়েছিল আবুল হোসেনের মনে। সেসময় গ্রামে গ্রামে যাত্রা পালা, পালা গানের প্রচলন ছিল বেশ। তাঁকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো সেসব পালার আবেদন বলে তিনি জানান। প্রায়ই বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে দেখতেন রূপবান পালা, পুষ্পমালা, ঝুমুর, ভাসান যাত্রা। একবার তাঁর বাবা তাকে ঘরের দরজায় শেকল পড়ায়ে আটকেও রেখেছিলেন। কিন্তু কার সাধ্য তার পায়ে বেড়ি পড়ায়? কাঁচি দিয়ে ঘরের ভেল্কি (বাড়ির ছাদ ও দেয়ালের মাঝখানের ফাঁকা স্থানের মধ্যকার এক ধরনের আস্তর) কেটে, গাছ বেয়ে পালিয়ে যান। নাটকটার নাম ছিল “পুষ্পমালা”। নাটকে একটা গান ছিল, নায়িকা তার স্বামীর জন্য গাইবে, “শুনিয়া স্বামীর কান্দন, যাইবো আমার প্রাণ.. না জানি কোন বিপদ ঘটেছে”। গানটা কেন যেন তাকে বড় টানতো।
আবলু হোসেন বলেন, “তহন তো নাটকে মেয়েছাল আছিল না। পুরুষরাই মাইয়া মাইনষের পাট গাইতো। আমি পাগলের মতো গানটা গাওনের জন্যে দলের সাথ সাথ মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছুইট্টা বেড়াইছি।” মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিভিন্ন পালা গানে নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন তিনি। পালাগান বা নাটকের প্রতি এতো তীব্র ভালোবাসা কীভাবে কাজ করেছে আবুল হোসেনের মনে জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রত্যেকটা নাটকে একটা করে বিবেক (শিক্ষনীয় বিষয়) থাকে, যা আমাদের মধ্যে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়, বোধোদয় ঘটায়। এই বিষয়টাই তাঁকে নাটক দেখার বিষয়ে আগ্রহী করে।
নাটকের গল্প থেকে বেরিয়ে, পাশে রাখা দোতারার দিকে উদ্দেশ্যে করে তাঁর আধ্যাত্মিক গান চর্চা প্রসঙ্গে কথা হয়। এপ্রসঙ্গে বলেন, “গান এমন সূক্ষ্ম জিনিস, যে যেদিকে টানবে, গান সেদিকে যাবে।” একবার কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। সেখান থেকে নাটকের পাশাপাশি বাউল গান, বিচ্ছেদী গানের প্রতিও আগ্রহ বোধ করেন আবুল হোসেন। মূলত, লালন গীতির প্রতি অনুরাগের সূচনা ঘটে সেখানে। তিনি বলেন, “বাউল গানডা ভালোভাবে ধরলাম বিয়া করার পর..”। আবারো গান ধরেন তিনি, “সত্য বল, সুপথে চল, ওরে আমার মন।”
লালন গীতি চর্চা থেকে, ক্রমে “চাতক পাখি” নামের এক বাউল দলের সাথে যুক্ত হন। সেই সুবাদে দলের সাথে মানিকগঞ্জের বাইরে অন্যান্য জেলাতেও গান গাইতে যাওয়ার সুযোগ ঘটে তাঁর। সংসার ধর্মের দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে আলাদাভাবে নিজের জগত নিয়ে থাকতে চান, তাতে কোন বাধা পড়ে কিনা জানতে চাইলে জানান, পরিবারকে আস্তে আস্তে তিনি মানিয়ে নিতে পেরেছেন। প্রথমে বাবা-মা তাকে ফিরিয়ে আনার নানা চেষ্টা করলেও তিনি নিজ সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। বর্তমানে মা-বাবা বেঁচে নেই। স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী সবাই তাঁর এ জীবনাচারণে এখন অভ্যস্ত। সংসারের মায়া থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, তিনি নিজের খাদ্যাভ্যাসেও এক প্রকার নিয়ম মেনে চলেন। তিনি বলেন, “মা-বাবার বস্তু যদি ঠিক রাখতে চাই, তাহলে মাছ-মাংস খাওয়া বাদ দেওন লাগবো। তাইলে পরে, যে কিট মানুষের মধ্যে কাম ভাবনার জাগান দেয়, তা আর হবে না।” এজন্য প্রায় ৩ বছর ধরে তিনি নিরামিশ খাবার খাওয়ার চর্চা করছেন।
আধ্যাত্মিক গান চর্চার মাধ্যমে নিজেকে সকল মোহ থেকে বের করে চলার অবিরাম এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি কি, জানতে চাইলে বলেন, “কান্দা কিন্তু ব্যকটির সঠিক। তয়, গান এমন সূক্ষ্ম জিনিস, যে যেদিকে টানবে, গান সেদিকে যাবে। একটা গান ৫ ভাগে বিভক্ত। সূক্ষ্ম প্রেম, দাস্য প্রেম, বাতশল্য প্রেম, মধূ প্রেম, শান্তি প্রেম। এখানে সূক্ষ্ম প্রেম হলো সৃষ্টিকর্তার সাথে জীবের প্রেম, দাস্য প্রেম হলো বন্ধুসুলভ, বাতশল্য প্রেম হলো ¯েœহমূলক, যেমন- সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র ভালোবাসা, মধু প্রেম বলতে বোঝায় কাম মিশ্রিত ভাব আর শান্তি প্রেম হলো মা-শিশুর সম্পর্ক। সঠিকভাবে গানের চর্চা, কাম ভাবনার কিটকে প্রশ্রয় পাইতে দেয় না।”
আলাপচারিতায় ছেদ পড়ে। বাড়ি থেকে ডাক এসেছে, দুপুরের আহার গ্রহণের জন্য। তাঁকে উঠতে হবে। যাওয়ার সময় শেষ প্রশ্ন করা হয়, কিভাবে জীবনযাপন করে তাহলে একজন মানুষ সঠিক পথে চলতে পারবে? আবুল হোসেন বলেন, “আমি ব-কলম হবার পারি। কিন্তু, বিভিন্ন রাস্তায় আমার হাটা আছে। আমার মতে, মা-বাবার ওপরে কোন পীর নাই। কোন গ্রন্থে অন্তত তালাস করে পাই না। তাদের সেবা করেন। ওখানেই প্রকৃত সুখ আছে।”