প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সংগ্রামী নারী ফিরোজা বেগম
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
ফিরোজা বেগম। শ্যামনগর উপজেলার দাদপুর গ্রামে বসবাস করেন। দিনমজুর স্বামী আবুল খায়ের, সন্তান ও মাসহ ৪ সদস্যের সংসার তাঁর। বসতভিটাসহ মোট জমির পরিমাণ ১৭ শতাংশ। স্বল্প পরিমাণ জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ফিরোজা বেগম কিছুটা হলেও সংসারের স্বচ্ছলতা আনায়ন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছেন নিজ প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
বসতভিটায় বারোমাস বৈচিত্র্যময় ফসল ফলানো ছাড়াও হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, কবুতর পালনের মাধ্যমে সংসারের যাবতীয় চাহিদা পূরণে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের কারণে বর্তমানে ফিরোজা বেগমের কাজের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। ঘর সংসার দেখাশুনা করা, রান্নাবান্না, গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনাসহ বসতভিটায় সবজি চাষ এবং প্রাণী সম্পদ পালন করার কারণে তাকে দিনব্যাপী ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপরও তাঁর কোন অভিযোগ নেই। সংসারের ভালো অবস্থানের জন্যই তো এসব পরিশ্রম।
পরিবারের উন্নয়নে সামান্যতম অবদান রাখতে পারায় ফিরোজা বেগমের গর্বের শেষ নেই। স্বামীর সংসারে হাড়খাটুনি পরিশ্রম করলেও একসময় বাপের বাড়িতে বেশ ভালোই ছিলেন ফিরোজা বেগম। আর্থিক অবস্থা ভালো থাকায় অভাব-অনটন, কায়িকশ্রমের বিষয়গুলো তার কাছে অজানাই ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এমন পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো যেখানে অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। স্বামীরা ৫ ভাই জমির পরিমাণ ৫ কাঠা। দিনে দিনে স্বামীর ভাইয়েরা বড় হতে থাকে এবং নিজেদের ঘর সংসার তৈরি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বল্প জায়গায় একসাথে বসবাস করা সম্ভব না দেখে ভাইয়েরা যে যার মতো করে শ^শুরবাড়ী ও অন্যত্র জায়গা কিনে সেখানে চলে যান।
তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে যেতে বলেন শ^শুর তখন নেই কাছে কোন টাকা পয়সা। কি করবো বুঝতে না পেরে স্বামীকে নিয়ে বাপের ভিটায় উঠলাম। কিন্তু নিজেদের খুব খারাপ লাগলো যে শুধু বাপের ভিটায় কি করে থাকবো। স্বামী যোন মজুরি দিতে থাকে তাতেও কোন রকমে দিনটা চলতে থাকে। সাথে হাঁস-মুরগি পালন, দর্জি কাজ করে সংসারে সহায়তা করতে থাকি। কিন্তু ভাইয়েরা তা ভালো চোখে দেখেনা কিভাবে এখান থেকে বের হতে পারবো সে চিন্তা করতে থাকি। নিজেদের কিছু সঞ্চয়িত অর্থ, সমিতি থেকে ও অন্যের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাপের বাড়ির পাশে ১০ কাঠা জমি ক্রয় করি এবং সেখানে ছোট একটি পুকুর খনন করে বসতঘর তৈরি করি ২০১০ সালের দিকে। কিন্তু ঋণের বোঝা যেন কমছে না। ২০১৪ সালের দিকে স্বামী চাউলের বস্তা আনতে যেয়ে গাড়ী থেকে পড়ে মাঝায় ব্যথা পায় এবং পায়ের শিরার সমস্যা হয়। সেখান থেকে তিনি কোন ভারী কাজ করতে পারেনা। আর এরপর সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলি।’
ফিরোজা বেগম বলেন, ‘গ্রামীণ রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়াতে বাইরের কোন কাজে তো আর করতে পারবো না সেক্ষেত্রে বাড়িতে থেকে কিভাবে আয়ের পথ তৈরি করতে পারি সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করি। আমাদের ক্রয়কৃত এই ১০ কাটা জায়গায় আমি সর্ব্বোচ ব্যবহার করার চেষ্টা করি। এখানে মৌসুম উপযোগী সময়ে বিভিন্ন ধরনের ফসল (সবজি ও মসলা) চাষাবাদ করি। দেশিয় প্রাণী সম্পদ পালন করি। আর সেখান থেকে আমার আরেকটি জীবন শুরু করি।’
ফিরোজা বেগম জানান, এখন তিনি বসতভিটায় ১২ মাস সবজি চাষ করতে পারেন। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ লাগিয়েছেন। গ্রাম থেকে ডিম কিনে এনে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করছেন। পাশাপাশি ডিম বিক্রি করছেন। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে ফলজ গাছ ১৫ ধরনের, মৌসুম উপযোগী সবজি চাষ হয়। গবাদী পশুর মধ্যে আছে গরু-৪টি, ছাগল- ৯টি,পাতি হাঁস-৭টি, রাজ হাঁস-৩টি, মেরি হাঁস ৪টি, মুরগি-৩৫টি, কবুতর ১৮টি। এছাড়াও পুকুরে আছে হরেক রকমের স্থানীয় মাছ। প্রতিবছর সবজি চাষ ও গবাদি পশু পালন করে সংসারের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তিনি। নিজেকে এখন তাঁর গর্ব হয়। কারোর উপর তাকে নির্ভর করতে হয় না।
স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা ও প্রাণ বৈচিত্র্য সংরক্ষণে উক্ত ভূমিকা আমাদের কৃষি ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনেকখানি গুরুত্ব বলে মনে হয়। নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বশীল কৃষি জীবনকে টিকিয়ে রাখতে হলে ফিরোজা বেগমের মত যে সব নারী প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের সাথে সাথে আমাদের কৃষি সংস্কৃতিকে আগলে রেখে জীবিকা নির্বাহ করছে তাদেরকে মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের কাজকে আরো গতিশীল করতে হবে এবং তাঁদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের উৎসাহিত করতে হবে। তা না হলে বর্তমান ভবিষ্যতে আমাদের কৃষি নিজস্বতা ও বৈচিত্র্যতা একেবারে হারিয়ে যাবে।