ফসল বৈচিত্র্য রক্ষা ও বীজ সংরক্ষণে কৃষাণী পান্না আক্তার
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী মূলতঃ কৃষি প্রাণবৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ জীবনধারণের জন্য প্রাণবৈচিত্র্যের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে আসছে। কৃষির উৎপত্তির পর থেকে কৃষকের দ্বারাই কৃষি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলিয়ে যারা আমাদের অন্ন জুগিয়েছেন তাঁদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার উপর ভর করে ধীরে ধীরে সহ¯্র বছর ধরে গড়ে উঠেছে আজকের এই কৃষি সভ্যতা। আর এই কৃষি সভ্যতার মূল উপাদান হচ্ছে বীজ। বীজ সংরক্ষণের জ্ঞান এবং কৌশল অত্যন্ত মূল্যবান। আর এই মূল্যবান কাজটিই করে আসছেন আমাদের গ্রামাঞ্চলের কৃষক-কৃষাণীরা। দেশের আনাচে-কানাচে এমন অনেক কৃষক-কৃষাণী রয়েছেন, যারা বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে নিজের প্রয়োজনে এবং অন্যদের সাথে বীজ বিনিময় করে আনন্দ পান।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের এমনই একজন কৃষাণী পান্না আক্তার (৩৫)। স্বামী ও দুই মেয়েসহ চার জনের সংসার পান্নার। পান্না আক্তার নিজের উদ্যোগে প্রায় ১০ বছর ধরে বাড়ির আঙ্গিনার ৩৫ শতাংশ জমিতে বছরব্যাপী সবজি চাষ করে আসছেন। তিনি লাউ, শিম, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, করলা, মুলা, মরিচ, ঢেড়স, ঝিংগা, ডাটা, পুইশাকসহ বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেন। এছাড়া তিনি বসতভিটা চারপাশে স্থানীয় জাতের রিসা কলা, সাগর কলা, ডিংঙ্গা কলা ও সবরি কলার চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজার বিক্রি করে সংসারে খরচ করেন। বছরব্যাপী সবজি চাষ করায় সংসার চলাতে পান্না আক্তারের তেমন কোন বেগ পেতে হয় না।
পান্না আক্তার নিজ হাতেই নিজের প্রয়োজনীয় বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। তিনি নিজের উৎপাদিত স্থানীয় জাতের লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ধুন্দল, ঝিঙ্গা, ডাটা, পুইশাক, শিম ও ঢেড়সসহ বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজির বীজ নিজেই সংরক্ষণ করেন। নিজের প্রয়োজনীয় বীজ নিজে সংরক্ষণ করায় সময়মত তিনি বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করতে পারেন। তিনি নিজেই পছন্দের শাক-সবজির জাত বাছাই করে চাষ করেন। বীজ পরিপক্ক হলে পান্না আক্তার ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কৌশল তিনি দীর্ঘ দিনের কৃষি কাজের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছেন। এছাড়া তিনি গ্রাম পর্যায়ে বারসিক আয়োজিত বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার সঞ্চিত জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি প্লাস্টিকের বয়ামে, মাটির হাড়িতে এবং পলিথিনের প্যাকেটে বীজ ভরে বস্তায় বীজ সংরক্ষণ করেন। সংরক্ষিত বীজে যাতে সুস্থ্য এবং পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ও রোগমুক্ত থাকে সেজন্য তিনি বীজ রাখার পাত্রে শুকনো নিমপাতা/তামাকপাতা শুকিয়ে রেখে দেন। এতে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে বীজগুলো রক্ষা পায় এবং অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকে। মৌসুমে নিজের জমিতে বীজ রোপণের পর উদ্বৃত্ত্ব বীজগুলো তিনি গ্রামের আগ্রহী কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেন।
পান্না আক্তার নিজের বাড়িটিকে একটি আদর্শ পুষ্টি বাড়ি হিসেবে গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ‘ফচিকা অগ্রযাত্রা কৃষাণী সংগঠন’র মাসিক সভায় আলোচনা করে সদস্যরা পান্না আক্তার’র আগ্রহ অনুযায়ী তার বাড়িটিকে পুষ্টিবাড়ি ও বীজঘর হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধীরে ধীরে সকল সদস্যরা পান্না আক্তারের বাড়িটিকে একটি আদর্শ পুষ্টি বাড়ি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। পান্না আক্তারের বাড়িতে গড়ে তুলেছে একটি গ্রামীণ বীজঘর, বীজ ঘরে স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় বীজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের বিভিন্ন বোতল, বয়াম, মাটির হাড়ি ও প্লাস্টিকের বস্তায় পান্না আক্তার বীজগুলো সংরক্ষণ করেন। নিজে বীজ সংরক্ষণ করায় তাকে সবজি ও ধানের বীজ বাজার থেকে কিনতে হয় না। তিনি মহামারী করোনাকালীন সময়ে গ্রামের ৬৬ জন কৃষক-কৃষাণীকে বীজঘর থেকে তার সংরক্ষিত ৬ জাতের বীজ (লাউ, শিম, মিষ্টিকুমড়া, করলা, লালশাক, বারোমাসি মরিচের চারা ও বীজ) দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। গৃহপালিত পশু-পাখির বিষ্ঠা ও গোবর দিয়ে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে জৈব উপায়ে (রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া) তিনি সবজি চাষ করায় বাজারে তার উৎপাদিত সবজির বেশ মূল্য ও কদর রয়েছে। সবজি চাষের পাশাপাশি পান্না আক্তার ধান চাষেও গোবর ও কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেন।
এ বিষয়ে পান্না আক্তার বলেন, ‘আমি পঁচা গোবর ও কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে জৈব উপায়ে কোনরূপ রাসায়নিক সার ও বিষ না দিয়ে সবজি চাষ করি। গত আমন মৌসুমে আমি ১৫০ মণ কেঁচো কম্পেস্ট ধান ক্ষেতে ব্যবহার করেছি। ফলে আমার ধান চাষে খরচ যেমন কম হয়েছে, তেমনি মাটির গুণাগুণও নষ্ট হয়নি। আমার জৈব উপায়ে চাষকৃত সবজি খেতে খুব সুস্বাদু এবং বাজার চাহিদাও অনেক। আমি গ্রামের সকল কৃষক-কৃষাণীদেরকে বীজঘর থেকে বীজ নিয়ে বছরের বিভিন্ন মৌসুমে নিজ নিজ পরিবারের চাহিদানুযায়ী সবজি চাষ করার ও বীজ সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ দেই।’
পান্না আক্তারের বসতভিটায় সবজি চাষ কার্যক্রম দেখে ফচিকা গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীরাও তাদের বসতভিটায় সবজি চাষ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। চলতি খরিপ মৌসুমে সবজি চাষের জন্য গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা বীজঘর থেকে বীজ নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক কৃষক বীজঘর থেকে বীজ নেয়ার পাশাপাশি সংগৃহীত সবজি বীজ রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কেও পান্না আক্তারের নিকট পরামর্শ নিচ্ছেন। পান্না আক্তার শুধুমাত্র স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভর না করে স্বামীর পাশাপাশি কৃষি কাজ করে স্বামীর কষ্ট যেমন লাঘব করছেন, তেমনি পারিবারিক আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারের খরচ বহনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। স্বামী ও সন্তানের মূখে তুলে দিতে সক্ষম হচ্ছে নিজের উৎপাদিত নিরাপদ খাদ্য। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের রোজগারে পান্না আক্তারের চার সদস্যের পরিবার শান্তিতে ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে। পান্না আক্তার তার দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন। পরিবারের যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বামী তার পরামর্শ ও মতামত নেয়।