নানা আয়োজনে আর্ন্তজাতিক গ্রামীণ নারী দিবস-২০১৭ উদযাপন
বারসিক নিউজ ডেস্ক:
আমাদের গ্রাম বাংলার নারীরা কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বহুমুখী কাজের সাথে জড়িত। নারী তার আপন মনেই স্বাচ্ছন্দে এসব কাজ করে থাকে। সে ভাবে এটা আমার সংসার। আমার সংসারে আমি কাজ করবো না এটা কখনো হয় নাকি! অথচ আমাদের পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র নারীর এই কাজের কোন মূল্যায়ন করেনা। শুধু তাই নয়, নারী কাজের নেই কোন স্বীকৃতি।
কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকার প্রতি স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের চতুর্থ নারী সম্মেলনে ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে জেনেভা ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উইমেন ওয়ার্ল্ড সামিট ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করে এবং ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে গ্রামীণ নারী দিবস পালন করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিবটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস উদযাপন করে আসছে।
বারসিক দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে দিবসটিকে উদযাপন করে। মানিকগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম পর্যায়ে নানা আয়োজনে গ্রামীণ নারীদের কাজের স্বীকৃতি এবং অবদানকে সম্মান জানায়। মানিকগঞ্জ এবং নেত্রকোনার নানা আয়োজনের নানা খরব এবং আলোকচিত্র এই লেখায় উপস্থাপন করা হলো। তথ্য ও আলোকচিত্র দিয়ে সহায়তা করেছেন মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার, নীলিমা দাস, মো. শাহিনুর রহমান, কমল চন্দ্র দত্ত এবং নেত্রকোনা থেকে মো: আলমগীর ও রোখসানা রুমি।
“দূর্যোগ মোকাবেলা করেই গ্রাম বাঁচায় নারী” শ্লোগানকে সামনে রেখে মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের দিয়ারা ভবানীপুর গ্রামে দিয়ারা নারী উন্নয়ন সংগঠনের আয়োজনে এবং বারসিক এর সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালিত হয়েছে। গ্রামীণ নারীদের বহুমুখী কাজের স্বীকৃতির লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় গ্রামীণ নারীদের বক্তৃতা, বিভিন্ন ধরণের বীজের প্রদর্শনী, অচাষকৃত উদ্ভিদের রান্না প্রতিযোগিতা ও নারীদের অংশগ্রহণে ভারসাম্য দৌড় প্রতিযোগিতা। কিশোরীদের দেশাত্ববোধক গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুর” হয়। সভাপতি ও অন্যান্য অতিথীদের আসন গ্রহণএরপর অচাষকৃত উদ্ভিদের রান্না প্রতিযোগিতায় দিয়ারা নারী উন্নয়ন সংগঠনের ২৩ জন সদস্য ২৩ রকমের অচাষকৃত উদ্ভিদ দিয়ে রান্না প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা মিতরা ইউনিয়নে গোবিন্দপুর গ্রামে তালপুকুর কৃষক-কৃষানীর সংগঠনের উদ্যোগ আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস-২০১৭ উদ্যাপন করা হয় । সকাল ১০.৩০মিনিটে ১১ জন নারীর অংশগ্রহনের মাধ্যমে জেন্ডার সমতা নিয়ে একটি নাটিকা পরিবেশন করা হয়। নাটিকাটির নাম ছিল “মায়ার বাধঁন”। এই নাটিকাটির মাধ্যমে একটি পরিবারে নারীর হাজোরো কাজ, ভালোবাসা, কর্তব্য ও দায়িত্বগুলোর খন্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন নাট্য শিল্পিরা। পাশাপাশি, ২৪ জন নারী গ্রামীণ দৃশ্য চিত্রাংকনে অংশগ্রহণ করেন। চিত্রাংকনের মধ্যে তাদের মনের অনুভূতি যেমন নদী,গরু, গাছ, ঘর, পাখপাখালি এবং গ্রাম বাংলা দৃশ্য তুলে ধরেন। পরবর্তীতে সবাই র্যালীতে অংশগ্রহণ করে। র্যালীরপর সকলে হাড়িভাঙ্গা খেলায় মেতে উঠেন। অনেক আনন্দ ও স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রামীণনারী দিবস উদযাপন করেন এরঅকার প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু, শিক্ষার্থী এবং কৃষক-কৃষানী।
গ্রামীণ নারীদের বহুমুখী কাজের স্বীকৃতি, সম্মানও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য মানিকগঞ্জ জেলার পূর্বদাশড়া গ্রামের মনিঋষি পাড়ার শঙ্কর মনিদাসের বাড়ির সার্বজনীন শিব মন্দির প্রাঙ্গনে পূর্বদাশড়া-সরুন্ডি মনিঋষি একতা সমবায় সমিতির উদ্যোগে ১৫ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পূর্বদাশড়া ও সরুন্ডি এলাকার নারীদের নিয়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। এ দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে আলোচনা সভা, র্যালী, চিত্রাংকন ও গ্রামীণ খেলাধূলা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাল্যবিবাহ ও নারীদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা।
গ্রামীণ নারী দিবসের অনুষ্ঠানমালায় নারীরা বিভিন্ন পর্বে স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে প্রান্তিক নারীরা তাদের অধিকারের কথা বলেন। র্যালীতে বিভিন্ন দাবি নিয়ে স্লোগান দেয়। তারা পারিবারিক কাজের ন্যায্য মজুরি ও রাাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়। তারা মনে করেন এর মধ্য দিয়ে নারী পুর”ষের সমতায় সমাজ বিনির্মান সম্ভব হবে।
সদর উপজেলার পাশাপাশি সিঙ্গাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ব্রীকালিয়াকৈর গ্রামের নয়াপাড়ার সাহামুদ্দিনের বাড়িতে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস উদযাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের অর্ন্তভূক্ত ছিল আলোচনা সভা, নারী-পুর”ষ বির্তক- বিতর্কের বিষয় ছিল ‘কৃষিতে নারীর অবদান’, কিশোরি আড্ডা এবং প্রবীণ নারীর জীবনের গল্প শোনা। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে ব্রীকালিয়াকৈর নয়াপাড়া কৃষক-কৃষানি সংগঠন।
মানিকগঞ্জের পাশাপাশি নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নে জনউন্নয়ন পাঠাগার এবং চল্লিশা আইপিএম ক্লাব এর যৌথ উদ্যোগে গ্রামীণ নারীর গল্প বলা, গ্রামীণ নারীকে সম্মাননা প্রদান, বীজ বিতরণ, নিরাপদ খাদ্যের প্রদর্শণী, অচাষকৃত খাদ্যের মেলার আয়োজনের মধ্যদিয়ে চল্লিশা পাঠাগার প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য সংরক্ষণ, বীজ সংরক্ষণ এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ৮ জন নারীকে সম্মাননা হিসেবে একটি করে দেশীয় মুরগী পুরস্কার দেয়া হয়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর রয়েছে দূযোর্গ মোকাবেলার এক অসাধারণ শক্তি ও অভিজ্ঞতা। নানা সংকট মোকাবেলা করতে হয় নারীদেরকে। তবুও তাদের মূল্যায়ন নেই- বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের। সাধারণত একজন গ্রামীণ নারী ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার পূর্ব পর্যন্ত ১২০ ধরনের কাজ করে কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষদের কাছে সে কাজের মূল্যায়ন পায় না। আসুন এই গ্রামীণ নারী দিবসের মধ্য দিয়ে আমরা নারীর কাজের মূল্যায়ন করি। তাদের কাজের স্বীকৃতি দেই। নারীরা সমাজের অর্ধাঙ্গী কেবল মুখে না বলে মনে নেই, মেনে নেই। নারীদের নারী হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করি। একটু ভাবুন না “নারীরা ও মানুষ!”