ফসলবৈচিত্র্যতা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিত করে
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
খাল-বিল-নদী মিলে মানিকগঞ্জ জেলা। মাঠ-ঘাট নিচু হওয়ায় প্রতিবছর বন্যার পানিতে পলি পড়ে। কৃষকগণ পলি উর্বর মাটিতে চাষাবাদে সফল হয়। কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাঠে-ঘাটে সোনা ফলে। মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায়, বৈচিত্র্যময় সোনার ফসল। বাংলার চারিদিকে দেখা যায় সবুজ। সুন্দর এই দেশে কৃষকগণ মাঠে চাষ করেন ধান, শাক-সবজি, মসলা, ডাল, তেল ও ফল। পানিতে চাষ করেন মাছ। এই চাষকৃত খাদ্য এবং অচাষকৃত খাদ্য বৈচিত্র্যের মাধ্যমে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, নিশ্চিত হয় পুষ্টিকর খাবারও।
কৃষকগণ মাঠেঘাটে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলিয়ে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখছেন। ফলে শুধুমাত্র মানুষের খাদ্যই নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু সুষম বা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রয়োজন। তাই তো কৃষকগণ তাদের উদ্ভাবনী কৃষি চিন্তার মাধ্যমে মিশ্র ফসল চাষ করেছেন। তাঁরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবেলায় বস্তায় বা টবে লতা জাতীয় শাকসবজি চাষ করেন, শীতে কুয়াশা মোকাবেলায় খড় বা পলিথিনের ব্যবহার করে শাকসবজি ও ধান বীজতলা তৈরি করেন, মাচায় লতা জাতীয় ফসল মাটিতে শাকসবজি চাষ করেন, জমিতে প্রধান ফসলের সাথে সাথি ফসল চাষ করেন, পতিত চরের জমিতে কলা ও মিষ্টি কুমড়া চাষ করেন, পোকার আক্রমণ রোধে হলুদ ফুল চাষ করেন এবং ফসল তোলার পর (মরিচ বা বেগুন) গাছ ব্যবহার করে লতাজাতীয় ফসল চাষ করেন। এসব উদ্যোগগুলোর উদ্দেশই হচ্ছে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন করা এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা। এই প্রসঙ্গে কৃষক বদ্যনাথ সরকার (৬০) বলেন, “পদ্মা নদীর সাথেই হরিরামপুরের চর, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর পানি প্লাবিত হয়ে মাঠে-ঘাটে পলি পড়ে। ফলে বৈচিত্র্যময় ফসল আবাদ করা সহজ হয়। কৃষকদের সীমত জমিতে নিজেদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা খাটিয়ে বীজবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে উৎপাদন করে আসছেন। এলাকার কৃষকগণ একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও পর্যবেক্ষণ করার মধ্য দিয়ে রবি মৌসুমে ফসল বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছেন। হরিরামপুর এলাকা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কালিমটর, তিশি, পায়রা চাষ করছি। পায়রা চাষের মধ্যে দিয়ে কৃষি সংস্কৃতি রক্ষা পায়।”
পাটচরগ্রামের কৃষাণী হাজেরা বেগম (৫০) বলেন, “পদ্মা নদীর ভাঙ্গা-গড়ার মাধ্যমে কৃষিজমি কমে যায়। চর এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মাঠ দিয়ে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় জমিতে পলি পড়ে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের নলখাগড়া, কাইশ্যা, কলমী, ডল কলমী, বাদাল, দুর্বলা, জলদুর্বা ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ জন্ম নেয়। আমরা জমির ঘাসগুলো পরিষ্কার করে চাষাবাদের উপযোগী করে তুলি।” এলাকায় কৃষকরা রবি মৌসুমে ফসল চাষ করেন মরিচ (বিন্দু, আলম ডাঙ্গা, বাল্লায়া), পিয়াজ, রসুন, ধনিয়া, রাধুনি, সরিষা চৈতা, মাঘি, বারি-১৪), তিষি, মুসুর ডাল, মটর, ধনিয়া, মেথি, কালিজিরা, পায়রা, গম তিল, বাদাম, কাউন ইত্যাদি। অন্যদিকে আউশ মৌসুমে তাঁরা পরাংঙ্গি, কালা আউশ ধান, আমন মৌসুমে হিজল দিঘা, ছোট ভাউয়াল্যা, দিঘা, মধুশাইল, শিশুমতি ধান চাষ করেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, “কৃষকদের সফলভাবে কৃষি কাজের ফলে মানুষের খাদ্য নিশ্চিত সম্ভব হয়েছে। এখন কৃষকদের প্রয়োজন বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা। পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের জন্য ফসল বৈচিত্র্যতা বাড়ানো প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন, “দুর্যোগ সহনশীল বিভিন্ন জাতের তেল, ডাল, মলা, শাক-সবজি, ধান চাষের মাধ্যমে কৃষকদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি হবে। এতে করে কৃষক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদে লাভবান হবে ও বীজবৈচিত্র্য সংরক্ষণের করে চাষাবাদ সফল হবে।”