ফুলে ফুলে বসন্ত
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই বসন্তের অপরূপের মহিমা গেয়েছেন। বসন্তকাল মানেই প্রকৃতিজুড়ে ফুলের মেলা! যেদিকেই চোখ যায়, শুধু নয়নাভিরাম ফুল আর ফুল।
বঙ্গাব্দের বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় এসময় বাংলার প্রকৃতি। বসন্তকালে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় ফুলের সুগন্ধ। বাগানে বাগানে সৌন্দর্যের আলো ছড়ায় জুই, চামেলি, রজনীগন্ধ্যা, শিমুল, হাসনাহেনা, গোলাপ, লাল গুল মেহের (কৃষ্ণচূড়া) আর হলুদ রঙের রাধাচূড়া।
রাজার আগমনে যেমন চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে যায় তেমনি বসন্তের আগমনে প্রকৃতিও নতুন সাজে সেজে ওঠে। প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয় প্রকৃতিতে। বসন্তের ছোঁয়ায় শীতের খোলস ছেড়ে ফুলে ফুলে ভরে উঠে বৃক্ষরাজি। শিমুল, পলাশ, পারুল, কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার লাল রঙে রঙিন হয়ে ওঠে গ্রামের পর গ্রাম, বন-বাদার, বাগ-বাগিচা। তাদের প্রস্ফুটিত হাসিতে মনে হয় যেন বনে লেগেছে আগুন রঙের খেলা। আর গাঁদা ফুলের হলুদ আর বাসন্তী রঙ ছাড়াও লাল, নীল, বেগুনী, গোলাপী, সাদা, খয়েরী হরেক রঙের ফুলের সমাহার। শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়ে কলমি ফুল জানান দেয় তারাও পিছিয়ে নেই।
এছাড়াও মহুয়া, বকুল, সুরভি রঙ্গন, পুলক জুঁই, গন্ধরাজ, শ্বেত শিমুল ও কুর্চি, করঞ্জা, শিরীষ, শিশু, কালো কড়ইগাছে সুগন্ধ ফুল ফোটে বসন্তে। কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালু, অশোক, নাগকেশর অর্জুন, হরিতকি, জংলি বাদাম, দেশী বাদাম, দেবদারু, তেঁতুল, বৃষ্টি শিরীষ, গগন শিরীষ সেগুন, বাংলার আকন্দ, ভাঁটফুল, নিম, নিসিন্দা, পাখিফুল, হস্তিশুঁড়, গিমে, ঢোল কলমি মাধবী মধুমালতী ফুলে ভরে উঠে বাংলার প্রকৃতি। ফুলের গন্ধে মাতওয়ারা হয়ে পাখিরা কচিপাতার ফাঁকে ফুলের মঞ্জরি মধু পান করে মিষ্টি সুরের গান ধরে। শীতের জীর্ণতা আর মলিনতা কাটিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি ফিরে পায় সচেতন নতুন প্রাণ।
মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত থাকে ফুল বাগান। ফুলে ফুলে বসে আর মধু পান করে। ডালে ডালে পুঞ্জিত আ¤্র মকুল। মৌমাছির গুঞ্জুরি যেন সুরেলা সঙ্গীত। গাছে গাছে পাখির কিচির মিচির জানান দেয় ওদের আনন্দের উচ্ছ্বাস। মনে হয় খাঁচা থেকে সদ্য মুক্তি পেয়ে ওরা এখন মুক্ত বিহঙ্গ। মাঠে-ঘাটে মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায় ফড়িং আর রঙিন প্রজাপ্রতিরা।
পলাশ-শিমুল ফাগুনের ফুল-বসন্তের ফুল-ভালোবাসার ফুল। বাঙালির সংস্কৃতির আবাহনে হৃদয়কে সাজায় পলাশ-শিমুলের লাল আভা। এ ফুলের সৌন্দর্য্যে চারিপাশে যেন সুখকর উৎসবের রোমাঞ্চ বয়ে যায়।
ফুল বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মারফত জানা গেছে, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে শিমুল এসেছে এই বাংলায়। ইংরেজি নাম সিল্ক কটন। বৈজ্ঞানিক নাম বোমবাক্স সিইবা। মালভেসি গোত্রভূক্ত শিমুল ১৮ রকম হারবাল ওষুধে ব্যবহৃত হয়। আর প্রকৃতি তার আপন লীলায় মত্ত হয়ে পত্রহীন গাছের নগ্ন ডালে উজ্জ্বল লাল বা গাড় কমলা রঙের পলাশ ফুটিয়ে মানুষের আদর ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলে। বাংলার হাজার হাজার বৃক্ষরাজির মধ্যে পলাশ অন্যতম। রঙেভরা বসন্তে এই ফুলের বিশাল দখলদারিত্ব। যার বৈজ্ঞানিক নাম- Butea monosperma। পলাশ মাঝারি আকারের পত্রমোচী দেশীগাছ। তিনটি পত্র নিয়ে যৌগিকপত্র। ফুল ফোঁটে বসন্তে। ৭.৫ থেকে ১০ সে.মি. আয়তনের শিম ফুলের মতো।
মানিকগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জ্জী বলেন, মূলত প্রকৃতির মিলন হয় বসন্ত ঋতুতেই। আর পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। তিনি আক্ষেপের সুরে জানালেন, দিন দিন শিমুল-পলাশ গাছ উজাড় হওয়ায় প্রকৃতির রূপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রকৃতি রাঙানো গাছ লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।”
ফুলের জগতে কৃষ্ণচূড়ার মতো এমন উজ্জ্বল রঙের ফুল বেশ দুর্লভই বটে। বর্ষার শেষেও এই গাঢ় লাল- কমলা ফুলের রেশ শেষ হয় না। তবে শীতের হিমেল হাওয়ায় গাছটির পাতাগুলো ঝরে যায়। বসন্তে- গ্রীষ্মে গাছগুলো আবার ভরে ওঠে গাঢ় লালে- কমলায়।
বেলী ফুলের গাছ বেশ ছোট; ঝোপের মতো। উজ্জ্বল সবুজ পাতার মাঝে সাদা রঙের থোকায় থোকায় ফুটে থাকা বেলী ফুল দেখতে যে কী সুন্দর, তা আর কী বলবো। মালা গাঁথায় এই ফুলের জুড়ি মেলা ভার! আর এই ফুলের গন্ধও দারুণ! চাঁপা বা চম্পা ফুলটির নাম এসেছে সংস্কৃত ‘চম্পক’ থেকে। চাঁপা ফুলের গাছ চিরসবুজ। মানে গাছে সারাবছরই পাতা থাকে। পাতাগুলো লম্বাটে। আর ফুলের রঙ সাধারণত সাদা, কিংবা হালকা হলুদ, সোনালিও বলতে পারো। আর এই ফুলের যা সুন্দর গন্ধ! বসন্ত থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত চাঁপা ফুল ফোটার সময়। বসন্তকালেই সবচেয়ে বেশি ফোটে। তবে এক শীতকাল ছাড়া প্রায় সব সময়েই চাঁপা ফুল ফুটতে দেখা যায়।
কনকচাঁপা ফুলের গাছটি ছোট বৃক্ষ জাতীয় গাছ। ফুলের মঞ্জরি ছোট ছোট, কিন্তু অনেকগুলো একসঙ্গে থাকে। পাতা যখন কচি থাকে, তখন রঙ থাকে তামাটে। কিন্তু পরিণত বয়সে পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রঙের হয়ে যায়। বসন্তে ফুলটির ঘন হলুদ সোনালি রঙের পাপড়ি আর তামা রঙের কচি পাতায় গাছের ডালপালা ছেয়ে যায়। কাঁঠাল চাঁপা ফুলের গন্ধটাই কাঁঠালের মতো। আর তাই ফুলটির নামই হয়ে গেছে কাঁঠাল চাঁপা। বিশেষ করে রাতের বেলায় ফুলটি গন্ধ ছড়ায়। আর ফুলটির রঙেরও একটা মজা আছে। ফুলটি প্রথমে থাকে সবুজ। পরে ক্রমেই হলদে রঙের হতে থাকে। আর ফুল যখন হলদে হতে থাকে, তখনই সুগন্ধ বের হয়। দোলনচাঁপা আমাদের দেশের খুবই পরিচিত একটি ফুল। গাছের ডালের মাথায় থোকায় থোকায় সাদা রঙের বড় বড় দোলনচাঁপা ফোটে। তবে সব দোলনচাঁপাই সাদা হয় না; কোনো কোনো জাতের দোলনচাঁপা হলদে কি লাল রঙেরও হয়। মোটমাট দোলনচাঁপার প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৪০টি।
নয়নতারা ফুলটি দেখতে বেশ অদ্ভূত, পয়সার মতো গোলাকার। আর তাই, গ্রামে এর একটা মজার ডাকনামও আছে- পয়সা ফুল। শুধু ফুলই না, এই গাছের পাতাও ডিমের মতো গোলাকার কোনোটির রঙ সাদা, কোনোটির গোলাপি, কোনোটির আবার সাদার উপর গোলাপি, আবার কোনোটির রঙ হালকা নীল। নাগেশ্বর বা নাগকেশর ফুলের রঙ সাদা। আর গোলাকার মুকুলের রঙ সবুজে-সাদা। ফুলের পাঁপড়ির রঙ আবার দুধ-সাদা। ফুলটা যে শুধু দেখতেই সুন্দর, তাই না, বেশ সুগন্ধিও বটে। এই ফুল শুধু সুন্দরী আর সুগন্ধি-ই নয়, একইসঙ্গে বেশ কাজেরও বটে। এই ফুল থেকে যেমন সুগন্ধি আতর তৈরি হয়, তেমনি নানা রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়।
বসন্তে গাঁদা ফুলের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বসন্তের সাজসজ্জায় গাঁদাফুলের বেশ প্রাধান্য রয়েছে। ডালিয়া বাগানে হরেক রঙের ডালিয়া পুরো বাড়ির চিত্রকেই পাল্টে দেয়। রঙিন এ ফুলেরা সগৌরবে জানান দেয় বসন্তের। চন্দ্রমল্লিকা শীতের মাঝামাঝিতে ফোটে। পুরো বসন্ত থাকে এর ব্যাপকতা।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বসন্তের রূপ তার নানান গান ও কবিতায় তুলে ধরেছেন। ‘এল এ বনান্তে পাগল বসন্ত/বনে বনে মনে মনে রঙ সে ছড়ায়রে/চঞ্চল তরুণ দুরন্ত’ ।
ফুল ছাড়া বসন্তকাল! কিংবা ফাগুনের আগুনলাগা দিনগুলো! কল্পনার অতীত। সুন্দর ফুল- সুন্দর পৃথিবী- সুন্দর মন নিয়েই বেঁচে থাকুক প্রতিটি মানুষ। বসন্ত বাতাস ভাটি বাংলার বাউল আবদুল করিমকেও জাগিয়ে তোলে। উতলা বাউল তাই গেয়ে ওঠেন, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’ বসন্ত এলে মন আনচান করে। বিভিন্ন ফুলের পরশে যেন ভালোবাসার কথাই মনে করিয়ে দেয় বারংবার।