শ্যামনগরে ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল দুর্যোগ প্রবন এলাকা হিসাবে পরিচিত। এখানে প্রতিনিয়ত নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে আছে। এ দুর্যোগের সাথে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী অনবরত নানান ধরনের উদ্যোগ ও কৌশল গ্রহণ করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন স্থানীয় পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে তার মধ্যে অন্যতম হলো মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহার। উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে দিনে দিনে ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিগত সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম জেলেখালী, কচুখালী, কুলতলী, ফুলতলা, ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের আবাদ চন্ডিপুর, শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের কালমেঘা, দেবালয় গ্রামের গ্রামে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
কালমেঘা গ্রামের কৃষানী অদিতি রানী ও বনশ্রী রানী বলেন, ‘আমরা আগে এ সারের ব্যবহার জানতাম না। আমরা ২০২১ সালের দিকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সহায়তায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখানে আমাদের দুজনকে ২টি নাদা ও কেচো সহায়তা করা হয়। সেখান থেকে আমাদের গ্রামের প্রায় ১৭ জন এভাবে সার তৈরি ও ব্যবহার করছেন।’ তারা আরো বলেন, ‘এ সার ব্যবহারের ফলে আমাদের ফসল উৎপাদনের খরচ কমে গেছে। এ সার সব রকম ফসলে ব্যবহার করা যায়। আমরা ধান-সবজি ও ফল গাছের পাশাপাশি মাছ চাষেও এ সার ব্যবহার করছি। এটি ব্যবহার করে যেমন জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করতে পারছি। তেমনি আবার সার ও কেচো বিক্রি করে একটি বাড়তি আয় হচ্ছে। আর আমাদের দেখে গ্রামের অন্যরা আগ্রহী ও উৎসাহিত হচ্ছে।’
পশ্চিম জেলেখালী গ্রামের কৃষক নেতা ভুধর চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘আমাদের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে অনেক এনজিও কাজ করে। তারা আমাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা করেছে এমনকি তারা জৈব সার ব্যবহার করতে বলেছে এবং জৈব সার কিনে দিয়ে সহায়তা করেছে। কিন্তু আমরা কৃষকেরা যে বাড়িতে এ সার তৈরি করতে পারি তা আগে কেউ বলিনি। বারসিক’র সাথে চলতি বছর যুক্ত হয়ে আমরা হাতে কলমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এটি দেখে গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রথম দুজনকে বারসিক সহায়তা করে শুধু নাদা দিয়ে আর এখন গ্রামের ২১ জন ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি ও ব্যবহার করছেন। আমরা পশ্চিম জেলেখালী গ্রামটি একটি ভার্মি গ্রাম হিসাবে দেখতে চাই। তার জন্য আমরা সংগঠন পর্যায়ে এটির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য প্রচারন এমনকি যে সফল হবে তাকে পুরুস্কৃত করা হবে।’
কুলতলী গ্রামের কৃষক প্রশান্ত সরদার বলেন, ‘এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা প্রতিনিয়ত জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দিচ্ছি। আমাদের জমিগুলো বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার না দিলে কিন্তু কোন ফসল হচ্ছে না। কিন্তু আমরা যদি ভার্মি কম্পোস্ট, গোবর সার, বাড়ির ময়লা আবর্জনা মাটিতে ব্যবহার করি তাহলে মাটি ভালো থাকবে। আর মাটি ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকবো। আমাদের মাটিতে যে নানান উপকারী উপাদান আছে সেগুলোও ভালো থাকবে।’
কৃষানী অল্পনা রানী মিস্ত্রি বলেন, যত দিন যাচ্ছে ততো আমাদের এলাকাতে ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে অনেকে প্রশিক্ষক হয়ে উঠছে। অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের নারীদের নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে নারীদের কিছূটা হলেও কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এ সার তৈরি একটি বিনাপুঁজির ব্যবসা একবার ভালভাবে শিখতে আর বুঝতে পারলে কিন্তু বাড়িতে বসেই আয়ের পথ তৈরি হচ্ছে।
বেতাঙ্গী গ্রামের কৃষাণী অনিতা রানী বলেন, ‘বর্তমানে আমার ৮টি নাদায় মাসে প্রায় ১৫০-২০০ কেজি সার উৎপাদন হয়। যা প্রতি কেজি ১৫-২০ দরে বিক্রি করি। আমার এ সার উৎপাদন করে একদিকে যেমন ভালো ফসল উৎপাদন হচ্ছে অন্যদিকে রাসায়নিক সারের জন্য বাড়তি অর্থ গুণতে হচ্ছে না। একই সাথে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি। এছাড়াও সারের পাশাপশি কেচো বিক্রি করে মাসে প্রায় ১২শ’ টাকার মতো আয় হয়। ’
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও মাটির সুন্বাস্থ্য রক্ষায় কেঁচো সারের জুড়ি নেই। এ জৈব সার মাটির পানি ধারণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে জমিতে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব। এ কারণে প্রতিনিয়ত কেঁচো সার ব্যবহার করার জন্য সরকারী-বেসরকারীভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। যার কারণে বর্তমান সময়ে কেঁচো সারের বাজারে ব্যাপক চাহিদা বেড়ে গেছে, যা গ্রাম-থেকে গ্রাম, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সম্প্রসারণ হচ্ছে।