জলবায়ু পরিবর্তন; বাড়ছে লবণাক্ততা, বিপর্যয়ে কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য
সাতক্ষীরা থেকে মৃত্যুঞ্জয় রায় অপূর্ব
লবণাক্ততায় পুড়ছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের মাটি। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি প্রাণ বৈচিত্র্য। ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবারই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নতুন নতুন এলাকা নদীর লোনা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এতে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মাটির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন। লবণের সাথে যুদ্ধ করে মানুষকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। গাছপালা মরে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে উপকূল।
বিশ^ব্যাংকের ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৯ জেলার ১৪৮টি থানার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে ১০টি নদীর পানি। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলার নদীগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকায় এখনই ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে, যা ২০৫০ সালের মধ্যে স্থানভেদে ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হতে পারে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তারা ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘এমনিতে শ্যামনগরের পানি লোনা। তার উপর প্রতিবছর বেড়িবাঁধ ভেঙে সবকিছু লোনা পানিতে ভেসে যায়। এ কারণে লবণাক্ততার মাত্রার বাড়ছে, কৃষি জমির পরিমাণ কমছে।
কৃষকদের এমন মন্তব্যের সাথে সুর মিলিয়েছেন কৃষিবিদরাও। তারা বলছেন, লবণাক্ততার কারণে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দীর্ঘমেয়াদী।
এ বিষয়ে শ্যামনগরের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. লতিফুল হাসান বলেন, ‘প্রতিবছর শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। সমস্যাটা শুধু প্লাবিত হওয়া নিয়ে নয়। একবার একটি উর্বর জমি লবণ পানিতে তলিয়ে গেলে, বৃষ্টিতে সেই লবণাক্ততা কাটাতে টানা দুই বছরের মতো সময় লাগে। কিন্তু লবণাক্ততা কাটতে না কাটতেই আবার প্লাবিত হয়। ফলে এখন এই অঞ্চলে ফসল কম হয়। বছরের পর বছর লবণ পানিতে তলিয়ে থাকায় জমির উর্বর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার এস. এম এনামুল ইসলাম ‘মে ২০২১’ থেকে ‘মে ২০২২’ পর্যন্ত সময়কালের চিত্র তুলে ধরে বলেন, শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় লবণের মাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিএস/মিটার। যত দিন যাচ্ছে, লবণের মাত্রা আরও বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণের মাত্রা ১৮ ডিএস/মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন তিনি, যা মারাত্মক ক্ষতিকর।
শুধু কৃষি প্রাণ বৈচিত্র্য নয়, লবণাক্ততায় ক্ষতি হয় মৎস্যচাষীদেরও। এ প্রসঙ্গে, শ্যামনগরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার বলেন, ‘মাটি একবার পানি থেকে লবণ গ্রহণ করলে, পানি মিষ্টি হতে প্রচুর সময় লাগে। এ সময়ে প্লাবিত হওয়া ঘের-পুকুর-জলাশয়ে মাছ চাষ করলে তাতে শতভাগ লোকসান হয়। মাছ প্রচুর খাবার খায় ঠিকই, কিন্তু লবণাক্ততার কারণে বড় হয় না।
তিনি বলেন, শ্যামনগর উপকূলের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় লোনা পানির প্লাবন ঠেকাতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের আপাতত কোন বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির পানি বরাবরই লোনা। আস্তে আস্তে কালিগঞ্জ উপজেলাকেও লবণাক্ততায় গ্রাস করছে। নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে লবণক্ততায় গ্রাসকৃত এলাকার আওতা সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে প্রতিবছর একাধিক দুর্যোগে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ায়। এতে মিষ্টি পানির আধারগুলো একেবারেই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব কৃষি, প্রাণ বৈচিত্র্যসহ সরাসরি মানুষর জীবনে পড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এতে জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। লবণাক্ততার আগ্রাসন কমাতে প্রাথমিকভাবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণেই সরকারকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে সাতক্ষীরা উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।