কাঁথা সেলাইয়ের মাধ্যমে সংসারে ব্যয় সাশ্রয়ী ভূমিকা রাখছেন শাহানারা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
‘আমার বৌ কিছু করেনা’-এই কথাটি আমরা প্রায় অনেক পুরুষের মুখেই শুনে থাকি। বিশেষ করে যে সকল নারী কোনো অর্থ উপার্জনকারী কাজের সাথে যুক্ত নয়। অথচ প্রতিটি পরিবারের নারীরা বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে সংসারে ব্যয় অনেকাংেশই সাশ্রয় করে থাকেন। তেমনি একজন নারী লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষীগঞ্জ গ্রামের শাহানারা।
তিনি রংপুরের মেয়ে, বিয়ে হয় আটপাড়া উপজেলার মনসুরপুর গ্রামের বীরপাশার সাথে। ঢাকায় কোনো একটি কারখানায় একসাথে দুজনে কাজ করতেন। সেই সূত্রে পরিচয় ও বিয়ে। সেখানে প্রায় ১৩ বছর একসাথে সংসার করেন। তিন বছর আগে তিনি স্বামীর সাথে আটপাড়ায় চলে আসেন। কিন্তু স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যরা তাদের এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। এই কারণে তারা লক্ষীগঞ্জ বাজারের কাছে একটি পরিবারের সাথে বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের একটি ছেলে আছে। স্বামী অটো চালক।
তিন সদস্য’র সংসারে খরচ চালাতে তার অটোচালক স্বামীর হিমশিম খেতে হয়। তারা যেহেতু অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাই বসতভিটায় সব্জী চাষ বা হাঁস, মুরগি পালনের মতো কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া স্বামীর উপার্জনের বেশিরভাগ অংশ প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের দিতে হয়। যে কারণে শাহানারার সংসারের পুরো খরচ তার স্বামীর পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।
তাই সংসারের অভাব পূরণের জন্য কোনো উপায় না পেয়ে শাহানারা আক্তার কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। তার বাড়ির পাশেই অগ্রগামী কিÐার গার্টেন স্কুল। সেখানে অনেক অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে আসেন। শাহানারা সেখানে গিয়ে অভিভাবকদের সাথে কাঁথা সেলাইয়ের বিষয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু কেউ তাকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নিতে রাজী হয় না। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি নিজের জন্য একটি কাঁথা সেলাই করে তাদের দেখায়। এটা অনেকেরই পছন্দ হয়। পার্শ্ববর্তী চকপাড়া গ্রামের একজন নারী তাকে প্রথমে একটি কাঁথা সেলাইয়ের ফরমায়েশ দেন। সেই থেকেই শুরু। এরপর থেকে একে একে অনেকেই তার কাছে কাঁথা সেলাই করতে দিয়ে যান।
কাঁথা সেলাইয়ের বিভিন্ন ধরণ অনুযায়ী এর পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়। যিনি কাঁথা সেলাই করাবেন তিনি কাপড় ও সূতা দিয়ে যান। সেই উপকরণ ব্যবহার করে শাহানারা একটি নতুন কাঁথা সেলাই করে দেন। প্রতিটি নতুন কাঁথা সেলাই করে তিনি এর পারিশ্রমিক বাবদ তিনশত টাকা পেয়ে থাকেন।
তাছাড়া কেউ যদি পুরনো কাঁথা নতুন করে সেলাই করতে দিয়ে যান সেক্ষেত্রে তিনি দুইশত পঞ্চাশ টাকা করে পারিশ্রমিক পান। একটি কাঁথা সেলাই করতে তার ২/৩ তিন সময় লাগে।
কাঁথা সেলাইয়ের টাকা দিয়ে তিনি সংসারের টুকিটাকি জিনিস বা স্বামী যখন সংসারের খরচ দিতে না পারেন, সেই সময়ে সংসারের চাহিদা পূরণ করেন। তাছাড়া নিজের কাপড়চোপরসহ স্বামী ও সন্তানের জন্য কাপড় কেনা, বাজার করা ইত্যাদি তিনি তার উপার্জনের টাকা দিয়েই করেন।
অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও তিনি বসতবাড়ির আঙিনায় কোনো সব্জী আবাদ করতে বা হাঁস, মুরগি পালন করতে পারেন না। পরিবারের খাবারের চাহিদা পূরণ করতে তার বাজারই ভরসা। খাবারের সকল উপাদান তাকে বাজার থেকে কিনতে হয়। স্বামীর সামান্য উপার্জন আর নিজের সেলাই কাজের উপার্জনে কোনো রকমে তার সংসার চলে।
শুধুমাত্র শীতকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ থাকেনা। তখন তিনি অলস সময় কাটান। সংসারেও অভাব দেখা দেয়। যদি তিনি সারাবছর কাঁথা সেলাই করে কোথাও বিক্রি করতে পারতেন তবে অভাব কিছুটা হলেও দূর হতো।
আমাদের গ্রাম বাংলায় এমন অনেক শাহানারা আছেন যারা কোনো না কোনো অর্থনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হয়ে নিজের সংসারে ব্যয় সাশ্রয়ী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের সংসারটা টিকে থাকুক। পরিবারের মানুষগুলো যেনো দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পায়।