পুকুর পুনঃখনন: আশ্রয়ন প্রকল্পে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ ও খাদ্য নিরাপত্তা
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে জেসমিন আরা ও বিশ্বজিৎ মন্ডল
আশ্রয় কেন্দ্র তৈরির পর থেকে পুকুরটা একবার ও কাটা (খনন) হয়নি। উপরের মাটির ধোয়ানি পড়ে পুকুরের তলা উচু হয়ে গেছে। এখন বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে পুকুর ভরে ওঠে। আর পুকুর ভরে গেলে উপরে পানি জমে যায়। মাটি নিচু থাকার কারণে কোন মৌসুমে আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাসকারীরা ভালো সবজি ফলাতে পারেননি। কিন্তু পুকুরটা পুনরায় কেটে মাটি ভরাট করার ফলে এখন তারা সারাবছর নানান রকমের তরিতরকারি করে খেতে পারছেন। পুকুর কাটার আগে সারাবছর মাটি ধু ধু করতো। তরিতরকারি তো দূরের কথা চরে বাঁধের উপর কয়টা গাছ ছাড়া কোন গাছ গাছালি ছিল না বলে জানান বাসিন্দারা। এখন তো সারাবছর কিছু না কিছু থাকে ক্ষেতে। বর্তমানে ওই এলাকার বাসিন্দারা সবজি ফলিয়ে কিছু বিক্রিও করতে পারনে। পুকুর পুনঃখননের কারণে কিভাবে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় ফসল ও খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রেখেছে উপরোক্ত বর্ণনায় সেটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে হুমকির সম্মুখীন বাংলাদেশের দাক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এ অঞ্চলের নিত্যসঙ্গী। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘরছাড়া হতে হয় প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর অনেক মানুষকে। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কতিপয় মানুষ বাস্তুভিটায় ফিরে গেলেও ফিরতে পারেননি অনেকে। তারা কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে পাশ্ববর্তী গ্রামের খাস ভূমিতে, কাজের সন্ধানে কেউ চলে গেছে শহরে, কেউবা বাইরে। আবার কেউ আছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি খাস জমিতে গড়ে ওঠা পূনর্বাসন কেন্দ্রে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর তেমনি এক পুনর্বাসন কেন্দ্র বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্প।
২০০২ সালের দিকে ৩ একরের একটু বেশি জায়গা নিয়ে ব্যারাক (আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে) তৈরি হয়। একটি বেডে ৫টি শেড তৈরি হয়। প্রতিটি শেডে ১০টি করে ঘর তৈরি করা হয়। মোট ৫০টি ঘর নিয়ে ব্যারাক নির্মিত হয়। সুপেয় পানি ও গৃহস্থলির কাজে ব্যবহারের জন্য ব্যারাকের মধ্যে একটি পুকুর খনন করা হয় এবং এই পুকুরে একটি পিএসএফ ফিল্টার স্থাপন করা হয়। উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৪টি গ্রামের জেলে, হিন্দু, মুসলিম পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। বর্তমানে ২৫টি মুসলিম ও ৪টি হিন্দু পরিবার বাস করছে। এ পরিবারগুলোর মধ্যে অনেক পরিবার আছে যারা বাস্তুভিটায় জায়গা সংকুলানের অভাবে ব্যারাকে আশ্রয় নিয়েছে। চুনা নদীর ভেঁড়ি বাঁধ সংলগ্ন তৈরি ব্যারাকটি। নদীর চরে পুকুর কেটে ভিটা তৈরির মাধ্যমে ব্যারাক নির্মাণ করা হয়। ব্যারাক নির্মাণের শুরুতে পুকুরটি সম্পূর্ণরূপে খনন না হওয়ায় ভেড়ী বাঁধের সমান্তরালে ব্যারাকের ভিটা উচু করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে ব্যারাকের ভিটা একটু নিচু থাকে। ফলে আগ্রহ থাকা সত্বেও আশ্রয় জনগোষ্ঠী চাষাবাদ করতে সক্ষম হতে পারেননি।
এমতাবস্থায় পানখালী ব্যারাকের অপরপাশে অবস্থিত বুড়িগোয়ালিনী ব্যারাকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্যারাকের পরিবেশ উন্নয়নে আশ্রয় জনগোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠে। বারসিক’র সহায়তায় পুকুর পুনঃখননে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন বরাবর আবেদন করেন বাসিন্দারা। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সরকারের ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় পুকুর পুনঃখননের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পুকুরে পানি থাকার কারণে পুকুর সেচ দিয়ে শুকানোর পরামর্শ দেয়া হয়। আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী ও বারসিক এর যৌথ উদ্যোগে পুকুরের পানি অপসারণ করে পুকুর শুকানোর ব্যবস্থা করা হয়। পুকুর শুকানোর পর ইউনিয়ন পরিষদের কর্মসৃজন কর্মসূচির মাধ্যমে পুকুরটি পুনঃখননের মাধ্যমে পুকুর পাড়ে মাটি দিয়ে ভিটা উচু ও পাড় বেঁধে দেয়া হয়। ভিটা উচু করার ফলে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর সবজি চাষের উপযোগি একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে। এরপর থেকে শুরু হয় ব্যারাকে সবজি চাষ। স্বল্প জায়গার মধ্যে বৈচিত্র্যময় সবজি কিছু ফলজ ও বনজ গাছ রোপণের চেষ্টাও করেন। আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় পুকুর পুনঃখননের ফলে কয়েক মাসের ব্যবধানে ব্যারাক সবুজ হয়ে ওঠে। চাষাবাদ হতে থাকে বৈচিত্র্যময় ফসলের। যা পারিবারিক খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে পাশাপাশি সবজি বিক্রি পারিবারিক আয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এছাড়া পুকুরে বৈচিত্র্যময় মাছ চাষের সুযোগও তৈরী হয়।
আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা উন্নয়নের ক্ষেত্রে আশ্রয়ন প্রকল্পের পুকুর একটি বড় ভূমিকা রাখে। তাই আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ সহযোগিতা আশ্রয়ন প্রকল্পকে প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করেছে, নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করেছে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর পরিবারের খাদ্য চাহিদা। বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ, কৃষিচর্চা ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা পরিচালনার একটি বাস্তব উদাহরণ হতে পারে আশ্রয়ন প্রকল্প। আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর এই জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করা হলে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠবে বৈচিত্র্যময় প্রাণের সম্ভার যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
* প্রথম ছবিটি পুকুর পুনঃখননের আগের চিত্র
** দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছবি দু’টি পুকুর পুনঃখননের পরে তোলা
–