বছরে ৩টি গাছ রোপণের অঙ্গীকার করেন নেত্রকোনার একটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
নেত্রকোনা রুখসানা রুমী
নেত্রকোনা কর্মএলাকার বিভিন্ন গ্রামে জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছোট ছোট জনসংগঠনগুলো এলাকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় ও এলাকার পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে সাংগঠনিক উদ্যোগে নিজ নিজ এলাকার রাস্তা-ঘাট এবং এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৃক্ষ রোপণের মত মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে আসছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রমের এমনই একটি সংগঠন ‘অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন’। সংগঠনটি গড়ে ওঠার পর থেকেই গ্রামের পরিবেশ সুরক্ষায়, পুষ্টির চাহিদা পূরণে, স্বাস্থ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রাণবৈচিত্র্য উন্নয়নে গ্রামে একটি কিশোরী তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করে গ্রামের অসহায় জনগোষ্ঠীকে সরকারি-বেসরকারি সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে।
গ্রামে কোন শিশু জন্ম নিলে সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে ফলজ গাছ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় সুন্দর এ পৃথিবীতে তার আগমনের জন্য। তারা এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে এবং গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুন্দর করতে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে এলাকার ‘আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ এর শিক্ষাথীদের সাথে যৌথ উদ্যোগে কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণ ও পরিবেশ সুরক্ষা ও সংরক্ষণে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে প্রচারনাভিযান এবং পলিথিন দূষণ বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণে সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে শিক্ষামূলক বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সংগঠনের উদ্যোগে বালি আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়ন ও বিষমুক্ত নিরাপদ ফল উৎপাদন নিশ্চিতকরণে স্কুল প্রাঙ্গনে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সাথে যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ অভিযান কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়। কিশোরী সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এবং বারসিক’র সহায়তায় স্কুল ক্যাম্পাসে ৬২টি ফলের ও নিমের চারা রোপণ করা হয়। এছাড়াও স্কুলের দুইশত শিক্ষার্থী টিফিনের টাকায় নিজ নিজ বাড়িতে রোপণের জন্য প্রত্যেকে ২টি করে মোট ৪০০টি ফলের চারা এবং কিশোরী সংগঠনের ২০ জন সদস্য প্রত্যেকে ২টি করে ৪০টি ফলের চারা রোপণ করেছে। স্কুল ক্যাম্পাসে রোপিত ফলের চারায় বাঁশের খুটি ও বেড়া দেয়াসহ সমূদয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন স্কুল ব্যবস্থাপনা কমটি ও শিক্ষকগণ।
এই প্রসঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাহানাজ আক্তার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতিও প্রতিনিয়ত বিরূপ আচরণ করছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মোকাবেলার অন্যতম উপায় হল পর্যাপ্ত পরিমাণে বৈচিত্র্যময় বৃক্ষের সমাহার ঘটানো। তাই আমাদেরকে বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। গাছ আমাদের পরম বন্ধু, গাছ আমাদের মা, তাই আমাদের সকলেরই সামর্থ্য অনুযায়ী গাছ লাগানো দরকার।’ তিনি কিশোরী সংগঠন ও সকল শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিবছর নিজ উদ্যোগে কমপক্ষে ৩টি করে ফলের গাছ রোপণের আহবান জানান। স্কুলের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংগঠনের সকল সদস্যরা প্রতিবছর কমপক্ষে ৩টি করে ফলের চারা রোপণের শপথ গ্রহণ করে। প্রধান শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করে কে কয়টা বৃক্ষ রোপণ করেছে তার সত্যতা যাচাই করবেন বলে জানান। তিনি অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন এর সদস্যদেরকে বৃক্ষরোপনের মত মহৎ উদ্যোগ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
শিক্ষক তানবীর আহমেদ বলেন, ‘কোন অঞ্চলের ৩০ বছরের গড় আবহাওয়াকে জলবায়ু বলা হয়ে থাকে। ঐ স্থানের আবহাওয়া (বায়ুর চাপ, তাপ, গতি, আদ্রতা, উষ্ণতা) যা’ বিভিন্ন নিয়ামকের গড় পরিমাপ করে নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত। কিন্তু মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপন, শিল্প কারখানা স্থাপন ও বনভূমি ধ্বংসের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিসহ পরিবেশের সকল ক্ষেত্রে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক ঋতু বৈচিত্র্য, দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যা’ মানুষসহ সকল প্রাণীকূলের জীবনযাপনের স্বাভাবিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করা এবং মানব সৃষ্ট দূর্যোগ কমিয়ে আনা প্রয়োজন।’
মানব সৃষ্ট দূর্যোগ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূর্যোগের ফলে বিলুপ্তির পথে আমাদের দেশের অনেক স্থানীয় জাতের প্রাণী, ফসল, নদী, খাল, বিল, হাওর ও পাহাড়। এর ফলে বিঘ্ন ঘটছে প্রাকৃতিক খাদ্য শৃংখলের। জলবায়ুর এই বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে আমাদের কৃষির উপর। নেত্রকোণা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর। বেশির ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দিন দিন এ অঞ্চলের ফসলের জাত বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় নতুন প্রজন্মের বেশি বেশি বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ রোপণ ব্যতিত অন্য কোন উপায় নেই।
পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে, এদেরকে নিজের মত থাকতে দিতে হবে, তবেই পরিবেশ ও প্রকৃতি স্বভাবিক থাকবে এবং স্বাভাবিক আচরণ করবে। পরিবেশ ও প্রকৃতিকে স্বাভাবিক রাখতে হলে প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যময় জাতের পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃক্ষরাজি থাকতে হবে, আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম (যেখানে মোট ভূ-খন্ডের ২৫% বন থাকার কথা সেখানে আছে মাত্র ৯%)। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে আমাদের বনের পরিমাণ বাড়াতে হবে, আর এজন্য আমাদের সকলকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। সকল ধরণের গাছের যতœ নিতে হবে এবং গাছ আমাদের প্রয়োজন। তাই গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তার পাশে পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় গাছ রোপণ করতে পারলে প্রাণবৈচিত্র্য যেমন বৃদ্ধি পাবে, পাশাপাশি সুন্দর পরিবেশ তৈরি হবে। আসুন আমরা সকলেই নিজ নিজ গ্রাম, পাড়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পতিত জমি ও রাস্তার ধারে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণ করি। নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখি। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আমরা পরিবেশ সুরক্ষায় সক্ষম হব বলে আমার বিশ্বাস।
……….