আদিবাসী প্রান্তিক নারীর প্রচেষ্টায় পুকুর সংস্কার
রাজশাহী থেকে মো. শহিদলু ইসলাম
লক্ষ্যে পৌঁছানোর অদম্য আগ্রহ আর ঐকান্তিক চেষ্টার কারণে আদিবাসী নারী দুই সন্তানের জননী আদরী মিনজ (৪৬) আজ গ্রামবাসীর কাছে হয়েছেন আদরণীয়। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রায় এগার কিলোমিটার পশ্চিমে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভাধীন সাত নম্বর ওয়াডের খ্রিষ্টান পল্লী ভুগরোইল গ্রামে তিনি হয়েছেন সবার কাছে অনুসরণীয়।
ভুগরোইল গ্রামটিতে ১৯৮০ সাথে বসতি শুরু হয়। সরকারি খাস খতিয়ান থেকে ভুমিহীনদের বসবাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৯৮১ সালে। বর্তমানে গ্রামটির প্রথম মোড়ল জোহান বিশ্বাস (৬০) এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের বাপ দাদারা পাহাড়িয়া আদিবাসী, শুনেছি তারা ঈশরদির পূর্ব থেকে এসে নওদা পাড়ায় বসবাস আরম্ভ করে। শুরুতে এখানে মাত্র সাতটি পরিবার বসবাস করলেও বর্তমানে (জুলাই,২০১৫) মোট ৪৫টি পরিবার বসবাস করছে যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে।” এখানকার প্রায় সকলেই দিনমজুর। অন্যের কৃষিজমিতে শ্রম দিয়েই তাদের রোজগার করে দিনাতিপাত করতে হয়। নারীরাও সংসারিক কাজের পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। জমির ফসল সংগ্রহের পর তাদের রোজগারের কোনো পথ থাকে না। অলস কর্মহীন দিন কাটাতে হয়। মৌসুমী বেকারত্ব এসময় অনেককে ঋণগ্রস্ত করে। পাশাপাশি আর্থিক এবং সামাজিক নানা সমস্যার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়। এখানকার শিশুরাও দিনে দিনে ক্রমশ স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ছে। এই গ্রামের যুবক নয়ন বিশ্বাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েও লেখা পড়ার খরচ যোগাতে না পেরে পড়াশুনা ছেড়েছেন।
আদিবাসী প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকটি পরিবারে সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া নিজস্ব বসতভিটাটুকু ছাড়া সর্বজনীন ব্যবহারের জন্য রয়েছে দুই বিঘা আয়তনের একটি সামাজিক পুকুর। পুকুরে মাছ চাষের টাকায় তারা অতি দরিদ্র পরিবারে বিয়ে ও চিকিৎসাসহ গ্রামটির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করতেন। কিন্তু গতবছর প্রবল বর্ষণে পুকুরটির পাড়ের বড় একটা অংশ ভেঙে যায়। যার ফলে পুকুরটিতে সুষ্ঠুভাবে মাছ চাষ ব্যাহত হয়। মাছ বিক্রির টাকায় গ্রামবাসী যেসব উন্নয়নমূলক কাজ করতেন তা বাধাগ্রস্ত হয় যা গ্রামটির সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
একমাত্র পুকুরটিই যাদের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম অবলম্বন সেই পুকুরের এই বেহাল দশায় গ্রামবাসী চিন্তিত হন। স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা যোগাযোগ করেন। ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে এক পর্যায়ে তারা হতোদ্যোম হয়ে ভেঙে পড়েন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি আদরী মিনজ। তিনি নিজে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের সাথে পুকুরটি পুনঃসংস্কারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে পুকুরের পাড় মেরামতের জন্য যোগাযোগ চালিয়ে যান। পাশাপাশি নিজেদের শ্রমে পুনঃসংস্কারের কাজের জন্য গ্রামের নারী পুরুষদের সংগঠিত করারও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সাথে তার যোগাযোগ হয়। বারসিকের সহায়তায় তিনি মানিকগঞ্জ, তানোর ও নাচোল এলাকার মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্পন্ন উন্নয়ন-উদ্যোগ পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর আদরী মিনজ গ্রামের নারী পুরুষের সমন্বয়ে একটি গ্রাম উন্নয়ন কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির মাধ্যমে ২০১৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই নিজেদের শ্রমে পুকুর পাড় মেরামতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিটি পরিবার থেকে একজন সদস্য দু’দিন কাজ করে পুকুরের পাড় বাঁধার কাজ শেষ করেন। যে কাজটির জন্যে প্রায় একবছর বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেও সমাধান হয়নি তা নিজেদের উদ্যোগে দুই দিনেই তারা সম্পন্ন করেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক উক্ত জনউদ্যোগ বাস্তবায়নে নানাভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আদরী মিনজ’র সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্ব ও কর্মতৎপরতার জন্য গ্রামবাসী তার প্রশংস করেন। তিনি গ্রামের শিশুদের স্কুলগামী করতে বারসিক’র সহায়তায় বর্তমানে ভুগরোইলে একটি শিশুবিকাশ কেন্দ্র চালু করেছেন। গ্রামটির দ্বিতীয় মোড়ল আলফ্রেড বিশ্বাসের বলেন, ‘এসব সম্ভব হয়েছে আদরী মিনজ’র জন্যে। তিনি আমাদের জাগিয়ে দিয়েছে, একতাবদ্ধ হতে অনেক কাজ করেছে’। আদরী মিন্জ বলেন, ‘সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর যৌথভাবে কাজ করলে কোন কিছুতেই বাধা আসবে না’। আদরী জানান, বর্তমান পুকুরে মাছের পোনা ছাড়্ াহয়েছে। আগামীতে এই মাছ বিক্রি করেই গ্রামের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা যাবে।
পুকুরে মাছের ছোট ছোট রূপালি রেনুপোনার মত ভুগরোইল গ্রামের প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের স্বপ্নগুলোও যেন ক্রমশ বাড়ছে ।