কৃষকদের জন্য পেনশন চাই
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনিতা বর্মণ
বাংলাদেশ একটি কৃষির্নিভর দেশ। শতকরা ৮০% ভাগের ও বেশি এলাকা কৃষি নির্ভর। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনে সম্পূর্ণ অবদান রাখছে সরাসরি কৃষক-কৃষাণীরা। কিন্তু কৃষক-কৃষাণীরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না। কৃষকরা প্রায়ই বঞ্চিত হন ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে। অন্যদিকে কৃষি পেশাকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। একজন কৃষককে চাকুরির জন্য অন্যের কাছে যেতে হয়। কিন্তু একজন কৃষক তার কৃষি কাজের উপর দিয়ে নিজের কর্মসংস্থানসহ আরো অনেকের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেন।
একজন বয়স্ক কৃষক তার কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে তার জন্য আর কিছুই থাকে না; খাদ্য উৎপাদক হয়েও এ সময়ে তাঁকে খাদ্যহীন অবস্থায় থাকতে হয় শুধুমাত্র কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে। অথচ সরকারি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেসরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার পর চাকুরিজীবীরা ভাতা বা পেনশন লাভ করেন যা দিয়ে তাদের বাকি জীবনটা খুব অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারেন। এই প্রসঙ্গে নাচোলের কৃষক আ: হামিদ বলেন, “বাংলাদেশ কৃষিখাতের জন্যই টিকে আছে। অনেক কৃষক কৃষি কাজ করে সংসারের জন্য খাবার জোগার করে। আমরা শুনেছি যারা সরকারি চাকরি করে, দেশকে সেবা করেন (শিক্ষক, ডাক্তার, অফিসার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি) তারা পেনশন পাই। সেক্ষেত্রে আমরাও তো দেশকে সেবা করি, দেশের জন্য খাদ্য উৎপাদন করি তাহলে আমাদের জন্য পেনশন নেই কেন?” বলা যায়, অবসর জীবনে কোন ভাতা বা পেনশন না থাকায় স্বয়ং কৃষকই তার খাদ্যের স্বাধীনতা হারান। খাদ্য উৎপাদক নিজেই যখন খাদ্যহীন অবস্থায় বাকি জীবনটা কাটান তখন নতুন খাদ্য উৎপাদক হওয়ার জন্য কেই সাহসী হয়ে আসতে চায় না; নিরাপদ জীবনের কোন নিশ্চয়তা না থাকায় এ পেশায় কেউ আগ্রহ দেখায় না। এভাবে একসময় কৃষক নিজেই কৃষির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কৃষক সন্তান বরং বিকল্প কর্মসংস্থান খোঁজাকে নিরাপদ মনে করেন।
সরকার যেমন কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, ঠিক তেমনি একজন কৃষকও সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে থাকেন। একজন কৃষক তাঁর ফসলের উৎপাদন মূল্য এবং বিক্রয় মুল্যের ক্ষেত্রে প্রতিমণে প্রায় ২০০ টাকা ভর্তুকি দেন। সে হিসেবে রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ভর্তুকি দেন একজন কৃষক। কিন্তু তার এই অবদানের প্রতিদান তো দূরে থাক স্বীকৃতিও জুটে না একজন কৃষকের! জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষকের অবদান থাকা সত্ত্বেও কৃষকরা বরাবরেই প্রতারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন।
আমরা যদি কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো কৃষকরা ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মাড়াই, কাটা, ফসল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রাখেন। কিন্তু বিনিময়ে তারা পাচ্ছেন প্রতারণা, বঞ্চনা, অবহেলা ও অবজ্ঞা। অন্যদিকে বাণিজ্যিক কৃষির ফলে কৃষক প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন তা কৃষকরা জানতেও পারেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন কৃষক উৎপাদন করেন ২৮ জাতের ধান (২৮ ধানের নাম)। এই চালের বাজার মূল্য ২৫-৩৫ টাকা। কিন্তু এই চালই মধ্যস্বত্বভোগীরা মেশিনে কেটে মিনিকেট নাম দিয়ে বিক্রি করছে; যার বাজার মূল্য ৪০-৫০ টাকা। কিন্তু এরা কোনভাবেই উৎপাদক নয়, কিন্তুই তারাই লাভবান হচ্ছেন। একই সাথে প্রতারিত হচ্ছে তাদের উৎপাদিত ২৮ ধানের নাম থাকছে না। ২৮ থেকে হয়ে যাচ্ছে মিনিকেট। ভোক্তাশ্রেণীও হচ্ছেন প্রতারিত।
নতুন প্রজন্ম যেমন কৃষিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে না। কীভাবে নেবে? এই পেশায় কোন লাভ নেই, নেই কোন স্বীকৃতি! বরং অবসর জীবনে এক অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি কে নিতে চাইবে? তাই একজন কৃষকের সন্তান কখনও তার বাবার মতো কৃষক হতে চান না; যা একসময় ছিলো। এখনই অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আধুনিক কৃষি আসার পর থেকে কৃষি থেকে যেমন কৃষকরা বিতারিত হচ্ছেন, কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে অন্যদিকে রাষ্ট্রী স্বীকৃতি এবং পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার কারণে অন্যান্য অতিহ্যবাহী পেশার পাশাপাশি কৃষি পেশাও প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কৃষি কাজ করে খুব নিশ্চিতভাবে জীবন কাটাতে পারছেন না নাচোলের কৃষক সিকান্দার আলী। তিনি বলেন, “রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কঠিন পরিশ্রম করে ফসল ফলাই নিজের জন্য, দেশের জন্য। এখন আমার শক্তি আছে বলে কাজ করতে পারছি, নিজে খেতে পারছি, বউ, বাচ্চাদের খাওয়াতে পারছি, দেশের মানুষদের খাওয়াতে পারছি। কিন্তু যখন কাজ করার শক্তি থাকবে না তখন আমাদের কৃষকদের কে খাওয়াবে?
কৃষকদের জন্য পেনশন চালুর দাবিকে সমর্থন করে নাচোল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. ওলিউল হক ডলার বলেন, “এই দাবি অযৌক্তিক নয়। অনেকেই বলতে পারেন-কৃষকদের জন্য আবার পেনশন কেন ? একসময় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি ছিল হাস্যকর। কিন্তু এখন তো সব স্বাভাবিক। একসময় কৃষকদের পেনশন ও স্বাভাবিক হিসেবে মনে হবে। সাংবাদিক হিসেবে এই দাবির সাথে একমত জানাচ্ছি।”
কৃষক নেতা হাসান আলী কৃষির প্রতি সবার উদাসীনতাকে উল্লেখ করে বলেন, “আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ বলে থাকি কিন্ত আমরা কৃষকরা কখনও প্রধান হতে পারি না কেন? আমরা কৃষকরাই তো আমাদের দেশকে কৃষি প্রধান করে তুলেছি। তাহলে আমরা কৃষকরা কেন এতো অবহেলিত, কেন সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত? এই প্রশ্ন শুধু কৃষক হাসান আলীর নয়; বাংলাদেশের সব কৃষকেরই! কৃষককে যদি নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা না দেওয়া হয় তাহলে তিনি কীভাবে দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিজের জীবনকে বির্সজন দেবেন? আমরা মনে করি, কৃষি পেশাকে আকর্ষণীয় করার জন্য এবং কৃষকের অবসর জীবনের ঝুঁকি কমানোর জন্য কৃষককেও পেনশন দেওয়ার সময় এসে গেছে!