সাতক্ষীরায় বৈচিত্র্য, আন্তনির্ভরশীলতা ও বহুত্ববাদী সমাজ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
বারসিক’র উদ্যোগে শ্যামনগরে গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি বৈচিত্র্য, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বহুত্ববাদী সমাজ বিষয়ক দুই দিন ব্যাপি প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালায় বারসিক শ্যামনগর কর্মএলাকার ৬ জন যুবক ও ১৫ জন কর্মী অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন বারসিক’র উপকূলীয় অঞ্চলের পরিচালক এবিএম তৌহিদুল আলম।


কর্মশালার প্রথমদিনে মানব সমাজ কি, বৈচিত্র্য কেন জরুরি এর প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ, বৈচিত্র্যের সাথে আত্তীকরণের সম্পর্ক কী, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা কী, আন্তঃনির্ভরশীলতার তত্ত্ব সম্পর্কিত ধারণা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও বহুত্ববাদী সমাজ, সমাজবদ্ধতা কি, বহুত্ববাদী সমাজ গড়বো কীভাবে, বহুত্ববাদী সমাজ নৈতিক মূল্যায়ন, বৈচিত্র্য এবং আন্তঃনির্ভরশীলতার সাথে সম্পর্ক কি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমাজের বিশ্লেষণ, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ কীভাবে করা যায়? আত্তীকরণ, বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরণের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়।

মানব সমাজ সম্পর্কিত ধারণায়ন বিষয়ে ২য় অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু করেন বাবলু জোয়ারদার। তিনি মানব সমাজ, সমাজবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা, মানব সমাজের বিকাশ সম্পর্কিত ধারণায়ন, সমাজে ঐক্য এবং দ্বন্দ্বের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেন। যেখানে বহু আগে থেকে শুরু করে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কীভাবে মানুষ পৃথিবীতে বসবাস শুরু করলো এবং সমাজ কাঠামো তৈরি হলো, পৃথিবী কীভাবে তার আকৃতি লাভ করলো তা নিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টরি দেখান এবং বিস্তারিত আলোচনা করেন।


মানুষ ও তার পরিবেশ বিষয়ে ৩য় অধিবেশন শুরু করেন রামকৃষ্ণ জোয়ারদার। তিনি মানুষের সাথে গাছপালা, পশুপাখি এবং প্রাণহীণ পারিপার্শে^র সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন। এখানে পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়। গাছ-পালা, প্রাণ-প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। মানবতাবাদ/ মানুষ কেন্দ্রিক মতবাদ- যেখানে মানুষকে বড় করে দেখা হয়, ভাবা হয় মানুষই শ্রেষ্ঠ। প্রতিবেশ নারীবাদ-এখানে পরিবেশ ও নারীকে একই সমার্থক ধরা হয়। নারীরা যেমন বিভিন্ন সমস্যা, নির্যাতন ও নানা ধরণের বৈষম্যের শিকার হয় তেমনি প্রকৃতিও নানা ধরণের বৈষম্য ও ধ্বংসের শিকার হয়ে থাকে বলে এখানে মনে করা হয়। প্রাণকেন্দ্রিক মতবাদ- এখানে কোনো একক প্রাণকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে সকল প্রাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বস্তুত সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রাণীর অধিকার ভিত্তিক মতবাদ-এ মতবাদ সমস্ত প্রাণির বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে মনে করে। প্রতিবেশকেন্দ্রিক মতবাদ- এ মতবাদ পরিবেশের উপাদানগুলোর মধে যে সম্পর্ক আছে তাকে গুরুত্ব দেয়।


বৈচিত্র্য সম্পর্কিত ধারণায়ন বিষয়ে ৪র্থ অধিবেশন শুরু করেন মফিজুর রহমান। বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্যের ধরণ ও বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্য সম্পর্কিত ধারণায়ন, কেন বৈচিত্র্য প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। মানুষ সমাজ ও প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বৈচিত্র্য প্রয়োজন। বৈচিত্র্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমন: প্রাণ ও প্রকৃতিগত, বস্তুগত, সামাজিক, ধারণাগত, সাংস্কৃতিক। অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে তিনটি দলে ভাগ করে বৈচিত্র্যের ধরণ লিখে দলগতভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং অংশগ্রহণকারীদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। তবে জোর করে বৈচিত্র্যকে বিনাশ বা ধ্বংস করলে সেটি অন্যের টিকে থাকার জন্যও সংকট তৈরী করে। বৈচিত্র্যহীনতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি অমনোযোগ প্রকৃতি ও পরিবেশ যেমন বিরূপ প্রভাব তৈরী করে তেমনি এটি মানুষের মন এবং সামাজিক বিকাশেও বাধা তৈরী করে।


বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরন বিষয়ে ৫ম অধিবেশন শুরু করেন বিশ^জিৎ মন্ডল। আত্তীকরণ, বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরণের সাথে সম্পর্ক, বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরণ বিষয়ে বারসিক’র দর্শন ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি তার আলোচনায় বলেন, ‘আত্তীকরণ একটি প্রক্রিয়া। উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমস্ত মানুষকে সম্পৃক্ত করে মূলধারায় যুক্ত করার প্রক্রিয়াই হলো আত্তীকরণ প্রক্রিয়া। আত্তীকরণের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন- সামাজিক আত্তীকরণ, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ, অর্থনৈতিক আত্তীকরণ ও অন্যান্য আত্তীকরণ। বারসিক’র আত্তীকরণের দর্শন ও প্রক্রিয়া- সামগ্রিক অর্থে জননেতৃত্বে উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য কাজ করে। জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা আত্তীকরণের একটি প্রক্রিয়া। আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক স্বীকার করার কৌশল বারসিক’র একটি আত্তীকরণ প্রক্রিয়া।


কর্মশালার ২য় দিনে গাজী আল ইমরান তার অধিবেশনে আন্তঃনির্ভরশীলতা, আমাদের জীবন যাত্রায় আন্তঃনির্ভরশীলতার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। বলা হয়, আন্তঃনির্ভরশীলতা হলো- একজন অন্যজনের সাথে, একজন বহুজনের সাথে, বহুজন একজনের সাথে, বহুজন বহুজনের সাথে কোনো না কোনোভাবে যে নির্ভরশীল তাই আন্তঃনির্ভরশীলতা। আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক বুঝানোর জন্য সুতা দিয়ে পানি, মাটি, পাখি, গাছ, মাছ, লাঙ্গল, মসলা, কুমার, তাঁতী, হাড়ি, তৈল ইত্যাদির যে সম্পর্ক তা বুঝিয়ে দেন গাজী আল ইমরান। এছাড়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আন্তঃনির্ভরশীলতার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেন।


আন্তঃনির্ভরশীলতার তত্ত্ব বিষয়ে বাবলু জোয়ারদার অধিবেশন শুরু করেন। আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক মূলত: দায়বদ্ধতা ও দায়-দায়িত্ব তৈরি করে। নিজের অহমবোধ প্রশমিত করে। আন্তঃনির্ভরশীলতার বিভিন্ন ধরণের গুরুত্ব রয়েছে। যেমন- ১. সামাজিক গুরুত্ব, ২. অর্থনৈতিক গুরুত্ব, ৩. পরিবেশগত গুরুত্ব এবং ৪. সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। এরপর আন্তঃনির্ভরশীলতার বিভিন্ন সম্পর্ক যেমন- বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন প্রাণের মধ্যে প্রতিবেশীয় সম্পর্ক, পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্ক, সহভোক্তার সম্পর্ক, পরজীবী পোষক সম্পর্ক, সিন্যাক্রোসিস সম্পর্ক, প্রতিযোগিতার সম্পর্ক, খাদ্য ও খাদক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে ডকুমেন্টরী প্রদর্শনের মাধ্যমে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
বহুত্ববাদী সমাজ সম্পর্কিত ধারণায়ন নিয়ে অধিবেশন শুরু করেন রুবিনা পারভীন। বহুত্ববাদী সমাজ কি, বহুত্ববাদী সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন। বহুত্ববাদী সমাজের নৈতিকতা হলো সমাজে বিদ্যমান সকল মত ও পথের নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমমনোযোগ তৈরি করা। সকলের অংশগ্রহণ, মতামত প্রদান, দায়িত্ব গ্রহণ, দায়িত্বপালন সমানভাবে পরিচালিত হয়। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয় এবং সর্বজনীন প্রাকৃতিক সম্পদ কখনোই ব্যক্তিগত দখল হয় না, সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত থাকে। বহুত্ববাদী সমাজে সকলের মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে।


পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ বিষয়ে চম্পা মল্লিক তার অধিবেশন শুরু করেন। বৈচিত্র্যতা,আন্ত:নির্ভরশীলতা এবং বহুত্ববাদী সমাজ এর পারস্পরিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যকের নাম, মায়ের নাম, দাদীর নাম ও দাদার নাম বলতে বলেন। তারপর তিনি বলেন, একবার চিন্তা করা যাক বৈচিত্র্য, আন্তঃনির্ভরশীলতা না থাকলে কী হতো বা হতে পারে? কিংবা বহুত্ববাদী সমাজের কথা আমরা চিন্তা করছি কেন? কারণ আমরা প্রকৃতির সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ প্রকৃতির সলের সাথে আমাদের কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে। আমরা মানবপ্রজাতি কোনোভাবেই এককভাবে বেঁচে থাকতে পারবো না। বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়মে আমরা টিকে থাকার লড়াইয়ে হারিয়ে যাব। প্রকৃতির ভেতর সবচে বেশি নির্ভরশীল প্রজাতি হিসেবে এই আমরা মানুষদের তাই অনেক কিছু সুরক্ষার দায় বর্তায়। আমাদের দায়িত্ব,কর্তব্য এবং সংগ্রামটা আরো বেশি জটিল। পরবর্তীতে সকলের অংশগ্রহণে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরী করা হয়।

সবশেষে বারসিক’র উপকূলীয় অঞ্চলের পরিচালক এবিএম তৌহিদুল আলম টেবিলের ওপর নানা ধরণের ছবি বিছিয়ে দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের পছন্দ মতো ছবি বাছাই করে প্রশিক্ষণের মূল্যায়ণ করতে বলেন। সবশেষে সহযোগী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশিক্ষণটি সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

happy wheels 2

Comments