কৃষকদের মধ্যে ঐক্য: বৃদ্ধি করে সুসম্পর্ক ও সংহতি
নেত্রকোনা থেকে সোহেল রানা
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। জীবন-জীবিকা উন্নয়নের জন্য সব কিছুই কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সকালের সূর্য ওঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় কৃষি জীবন চলে ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। প্রতিটি মূহুর্তের স্তরে স্তরে সাজানো কাজ। প্রকৃতির সাথে নিবিড় আলিঙ্গন দিয়ে জড়িয়ে আছে কৃষি-সংস্কৃতি। আর এই প্রকৃতিনির্ভর কৃষির সাথে নিবিড় সম্পর্ক কৃষকের। প্রকৃতির সাথে সম্পর্কেও সূত্র ধরে একজন কৃষক অন্য কৃষকের সাথে বসবাস শুরু করে গড়ে তুলে সমাজ। মাঠে যাওযার পর সকলে একসাথে কাজ করে, কাজের মধ্য দিয়ে আনন্দ করে, কাজে এক অন্যকে সহযোগিতা করেন। একজনের কোন উপকরণ কম থাকলে অন্যজনের কাছ থেকে নেয়। সুখ-দুখের কথাগুলো বলার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্প্রীতির সম্পর্ক।
নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার শুনুই ইউনিয়নের ফুলবাড়ীয়া গ্রামের কৃষকেরা এখনও পরস্পরের সাথে সুখ-দুঃখ, কাজ ও আন্তরিকতা বিনিময়ের সংস্কৃতি চর্চা করে আসছে। ২০১৩ সালে তাদের নিজের কৃষিসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে গড়ে তোলেন ফুলবাড়ীয়া কৃষক সংগঠন। সংগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরস্পরের সাথে শ্রম-উপকরণ এবং অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদন খরচ হ্রাস, কৃষিতে উপকরণের ওপর প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি তৈরি করা। উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কৃষকরা সোয়েব ঠাকুরের নেতৃত্বে গ্রামের গত এক বছর ধরে শুরু করেন হাঙ্গার পদ্ধতির মাধ্যমে একে অন্যের জমি রোপণ করার, ধানকাটার, সেচ, নিড়ানির, ধানকাটাসহ যৌথ কাজের। পর্যায়ক্রমে তারা প্রতিটি কৃষিকের জমিতে ওই সব কৃষি সংক্রান্ত কাজ করেন। এসব যৌথ কাজের করার শেষে তারা একসাথে পিঠা, পায়েস, খিচুরি এবং অন্যান্য খাবার গ্রহণ করেন। এ যেন এক একটি উৎসব! কাজের ফাকে, খাওয়ার সময় কিংবা বিশ্রামের সময় তারা পরস্পরের সাথে অভিজ্ঞতা, সমস্যা, সুখ-দুঃখ সহভাগিতা করেন। এভাবে তাদের মধ্যে গড়ে উঠে ঐক্য ও সংহতি। এভাবে দেখা গেছে, গ্রামের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, কৃষকের খরচ কমছে, তৈরি হচ্ছে সংহতি। ফুলবাড়ীয়ার কৃষকদের যৌথ কাজের এই উদ্যোগ বাংলাদেশ কিংবা নেত্রকোনা জেলার অন্য কৃষকরাও বাস্তবায়ন করতে পারেন। এতে করে তাদের কৃষি উৎপাদন খরচ কমবে, সম্পর্ক বাড়বে তাদের মধ্য এবং তৈরি হবে সংহতির, যা সমাজে স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি আনায়নে ভূমিকা রাখবে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আধুনিক কৃষি আসার পর থেকে প্রকৃতির সাথে কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ক, কৃষি সম্পর্কিত বিষয়ে কৃষকদের বিনিময় সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তই হতে চলেছে। এ বাণিজ্যিক কৃষির আসার পর থেকে কাঠের লাঙ্গলের বদলে এসেছে লোহার বড় বড় ফলার মেশিন, ঘাস নিড়ানির বদলে রিফিট জাতীয় বিষাক্ত আগাছানাশক এবং ধান ফলানোর উন্নত বীজ। ফলশ্রুতিতে কৃষিতে কৃষকের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তাই তো কৃষিতে প্রতি মৌসুমে একেক দিন একেক জনের বাড়িতে খাওয়ার, আনন্দ করার মহা উৎসবগুলো আর দেখা যায় না বললেই চলে। এক্ষেত্রে নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার শুনুই ইউনিয়নের ফুলবাড়ীয়া গ্রামের কৃষকদের এই উদ্যোগ অন্য এলাকার কৃষকদের অনুপ্রাণীত করবে। কৃষিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আবারও কৃষকরা পরস্পরের সাথে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শ্রম ও উপকরণ সহভাগিতা করবেন।