বাঙালির ধান উৎসব
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
পিঠা, পায়েস, খই, মুড়ি, খিচুরি ও ভাত সবই তো বাঙালিদের প্রধান খাবার। সাথে যুক্ত হয়েছে সুগন্ধি চাউলের পোলাও, বিরানি খাবার। এই সকল খাবার তৈরিতে প্রয়োজন হয় বৈচিত্র্যময় ধান। বিভিন্ন ধরনের ধান চাষের মাধ্যমেই ভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি ও স্বাদ পেতে পারি। বাঙালির রসনায় খাবার ও স্থায়িত্বশীল কৃষি আবাদের মাধ্যমেই ধানবৈচিত্র্য রক্ষা হতে পারে। কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের ধান চাষাবাদের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সকল প্রাণবৈচিত্র্যের খাদ্যের আধার নিশ্চিত হতে পারে।
ঘিওরের ভাঠইমুড়ির কৃষক সাইজ উদ্দিন মোল্লা (৫০) মনে করেন হেলাচিয়া চকে নিবিড় ধান চাষ হয়। আমন মৌসুমে ধান চাষের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। কারণ হিসাবে বলেন, ‘হেলিচিয়া-ভাঠইমুড়ি-কুন্দুরিয়া-মান্তার চকে আমন মৌসমে ধান বোনা হয়, আবাদ হয় রাসায়নিক সার ও বিষ ছাড়া। ফলে ধান আবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পোকা-মাকড়ের জন্ম ও মৃত্যু জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। আমন মৌসুমে ধানের উচ্চতা বেশি হওয়ায়, ধান কেটে নেওয়ার পর বাকি অংশ (খড়) জমিতে পঁচে মাটির উর্ববরতা বৃদ্ধি পেয়ে চাষাবাদের উপযোগি হয়। আমরা নিজেরা ধানের বীজ রেখে চাষাবাদ করতে পারি বলে কৃষকগণ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়।’
মানিকগঞ্জের হেলাচিয়ার কৃষক নিরাঞ্জন মনিঋষি (৪৮) বলেন, ‘এই চক এলাকার সবচেয়ে বড়, কিন্তু জমি নিচু হওয়ায় বেশি পানির ধান চাষ করা হয়। বেশি পানির ধান উৎপাদন কম, তবে উৎপাদন খরচ খুবই কম, উৎপাদন খরচ বলতে জমিতে চাষ ও ধান কর্তনমাত্র। আমন মৌসুমে এই চকে ছোট ভাউয়াল্যা, বড় ভাউয়াল্যা, দিঘা ধান বোনা হয় বৈশাখ মাসে, কর্তন করা হয় কার্তিক মাসে। মাঠের ৩০ শতাংশ জমিতে ৭ থেকে ৮ মণ ধান পাওয়া যায় ও খড় বাবাদ ৪০০০/- চার হাজার টাকা পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগে আমন ধানের ভাত। মরিচ দিয়েও খাওয়া যায়। এই ভাত খুবই সুস্বাদু, কোন অসুখ হয় না। আমন মৌসুমে ধান কর্তনের মাধ্যমেই কৃষকের হাসি ও নবান্ন শুরু হয়। আমাদের চকে ইরি ধান চাষ না করে, খেসারি ডাল, মরিচ, পিয়াজ, রসুন, ধনিয়া, কালো জিরা, রাধুনি সজ চাষ করে থাকি। এই সকল মসলা চাষ করার ফলে ধানের চেয়ে আমরা বেশি লাভবান হতে পারি।’
হাটিপাড়ার কৃষাণী কুসুমি রাণি (৫১) বলেন, ‘আগে আউশ ধান চাষ হত, এখন আর আউশ ধান চাষ হয় না। আমন মৌসুমে ডেপর, হিজলা দিঘা, আমশাইল ধান চাষ করি। অল্প সংখ্যক ধান আবাদের কারণে কৃষকগণ ধানের বীজ হারিয়েছেন। বেশি উৎপাদনের আশায় গুটি কয়েক ধানের জাত চাষ করায় সার ও বিষের ব্যবহার এবং পোকার আক্রমণ বেড়েছে, মাটির উর্বরতা কমেছে, আমাদের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। মাছসহ উপকারি পোকার অভাবে চাষাবাদে কৃষকগণ লাভের মুখ দেখতে পারছে না।’ এ অবস্থায় মাটি, পানি, পরিবেশ, কৃষক পর্যায়ে ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে ও চাষাবাদে সমস্যা সমাধানে কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক ধান জাত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে আমন ও বোরো মৌসুমে কৃষকগণ নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে এলাকা উপযোগী ধান বাছাই করে মকবুল, কাইশ্যাবিন্নি, রাজভোগ, পুইট্যা আইজং, চিনিগুড়া, মনিশাইল ধান সংরক্ষণ করছে।
হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জের কৃষাণি হাজেরা বেগম (৫৫) বলেন, ‘কৃষকগণ কার্তিক অগ্রাহায়ন মাসে ধান কাটলে পিঠা পায়েসের ধুম পড়ে। গ্রামের গরিব-ধনী সকল পরিবারেই কম বেশী পিঠা পায়েস তৈরি করে খাওয়া হয়। আমন মৌসুমের ধান উঠার সাথে পিঠা পায়েস খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতি। আমাদের স্থানীয় জাতের ধানের (হিজল দিঘা, মধুশাইল, শিশুমতি, দিঘা, পরাংগি আউশ) চাল দিয়েই পিঠা পায়েস ও খই, মুড়ি ভালো হয়।
কথায় আছে, ভাতে মাছে বাঙালি। একসময় গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে ছিল হাজারো রকমের ধরনের ধান। কৃষকদের মুখ থেকে শোনা যায় ধানের বিভিন্ন বৈচিত্র্য। বাংলার ঘরে ঘরে ছিল খাবারের বৈচিত্র্য মুড়ি, খই, পিঠা, পায়েসসহ রকমারি খাবার। কৃষকগণ মনে করেন, কৃষক নেতৃত্বে ধান গবেষণার মাধ্যমে এলাকা উপযোগী ও দুর্যোগ সহনশীল বিভিন্ন জাতের ধান চাষের মাধ্যমে তারা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন। কৃষক পর্যায়ে গবেষণা করে মাঠে ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধিসহ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকগণ সহায়ক হচ্ছে। কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ ও আবাদ করে সফল হচ্ছেন।