এ যুগের রোকেয়া কল্যাণী হাসানের গল্প শুনি
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
যেখানেই নারীর প্রতি সহিংসতা, অন্যায়, অবিচার, যেখানে নারী অসহায়, বাধাগ্রস্ত সেখানেই কল্যাণী হাসান। অসহায়, নির্যাতিত নারীরা ফোন করে কল্যাণী হাসানের সহায়তা কামনা করেন। বাল্য বিয়ে হচ্ছে উপস্থিত হয়ে গেছেন কল্যাণী হাসান, ছুটে যান সামাজিক নারী সংক্রান্ত বহুবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য।
প্রতিকূল পরিবেশেও অনেক নারী নিজের শ্রম ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে তুলে ধরেছেন। অনেকে হয়েছেন নারী জাগরণের অগ্রদুত। তেমনি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার দিঘদাইর গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা কামরুল হাসান ভূঁইয়ার স্ত্রী এই কল্যাণী হাসান। নারীর জীবনে আর্শীবাদ হয়ে আসেন কল্যাণী হাসান। জীবন সংগ্রামে সফল ও প্রতিষ্ঠিত একজন নারী কল্যাণী হাসান। শৈশব থেকে নিজের জীবনের সাথে, প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ-সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সাফল্যে নেপথ্যে রয়েছে সুবিন্যস্ত এক ইতিহাস। দুঃখকে জয় করে জীবনের পাটাতন শক্ত করেছেন। তবু কখনো হাল ছাড়েননি। শিক্ষা জীবনে বাবা কখনোই তাকে বই কিনে দিতে পারতেন না। শুধু বই কেন? দুই বোন এক ভাইয়ের সংসারে বাবা নিয়মিত ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন না! দু-বেলা পেট ভরে ভাত খেয়েছে-এমন দিন কল্যাণীর ছোট বেলায় কমই ছিল। তাই সবাই মিলে ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিতে চেয়েছিল। প্রতিবাদ করে বিয়ের পিড়ি থেকে উঠে যায়। প্রতিবাদ করে। এ বিয়ে হবে না। এ প্রতিবাদ সমাজ ভালোভাবে মেনে নেয়নি ।
জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী নারী কল্যাণী হাসান শিক্ষা জীবনে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি, এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি-তে স্টার মার্কসসহ আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের-উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগ থেকে বিএসসি (অনার্স) ও এম.এস.সি (মাস্টার্স) ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছেন।
তিনি ২০০০ সালে এম.এস.সি পড়া অবস্থায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। চাকুরির পাশাপাশি ২০০২ সালে কেন্দুয়া সদরে “মা জুয়েলার্স” নামে একটি জুয়েলারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। এ ব্যবসা শুরু করার সময় মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা মূলধন আর মনোবলই ছিল তাঁর একমাত্র সাথী। কেন্দুয়ায় তখন খুব কম নারী বাজারে আসা-যাওয়া করতেন। এ অবস্থায় একজন নারী বাজারে বসে ব্যবসা করবেন এটা তখনকার সময়ে মানুষজন মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, ভাবতেই পারতেন না। তাই প্রতিনিয়তই নানা প্রতিকূলতার সন্মূখীন হতে হয়েছে। সেই কল্যাণী হাসান বর্তমানে কেন্দুয়া বাজারের জুয়েলারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
প্রথমদিকে তাঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজনও তা মেনে নিতে চাননি। তাই সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে এবং স্কুল ছুটির পর তাঁকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আসতে হতো। তবে এ ব্যাপারে তাঁর স্বামী তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর কল্যাণী হাসান আজ একজন সফল ব্যবসায়ী। বর্তমানে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ৬/৭ জন লোক কাজ করছেন। তাঁকে দেখে আজ কেন্দুয়া সদরে অনেক নারী ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন। কল্যাণী হাসান বলেন, “২০০৫ সালে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে আমি জয়িতা পুরস্কার পেয়েছি । ২০১৬ সালে আনসার ভিডিপি একাডেমী থেকে সফল নানী উদ্যোক্তার পুরস্কারসহ আরো একাধিক পুরস্কার পেয়েছি।”
তিনি জানান, শুধু তঁর সন্তান নয়; সমাজের কোথাও যদি কেউ (আমার জানামতে) সমস্যায় পড়ে, যেমন-স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বা ফরম ফিলাপ করতে না পারে বা অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতার পাশে দাঁড়ানো, অসহায় সম্বলহীন মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা করা তাঁর জন্য নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং রাজনৈতিক পরিবারের বউ হওয়ার কারণে যেখানে যে অবস্থাতেই নারী নির্যাতিত হয় (রাতে-দিনে) সেখানেই স্ব-শরীরে উপস্থিত হতে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন নারী নির্যাতন বন্ধ, সঠিক বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্তি, শিশুর পুষ্টি ও শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তি নিশ্চিতকরণ ও ঝরে পড়া রোধে যথাসাধ্য কাজে করে যাচ্ছেন ।
তিনি বলেন, “নিজে বাল্য বিয়ের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলাম বলেই আজ প্রতিষ্ঠিত এবং অন্যের জন্য কাজ করতে পারছি। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই বাল্য বিয়ে বন্ধে রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছি।” আজ পর্যন্ত প্রশাসন ও উপজেলা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সহায়তায় ৬০টির বেশি বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। উপজেলা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সাঃ সম্পাদক হওয়ায় বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে এবং পাড়া-মহল্লায় কাউন্সিলিং ও উঠান বৈঠক করে থাকেন। সর্বদাই মা, বোনদের বুঝান যে, মেয়েদের ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছররের আগে বিয়ে করানো অন্যায়। তাই উপজেলাজুড়ে কল্যাণীকে বাল্য বিবাহ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আতংক বলে সম্বোধন করেন সকলে।
কল্যাণী হাসান বলেন, “নিজের জীবন থেকে আমি যে শিক্ষা অর্জন করেছি, সেটাই অন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। তাই এলাকার কোনো মেয়ে বা ছেলের বাল্যবিয়ের খবর পেলে তা বন্ধ করতে ছুটে যাই।” প্রথমে অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। এতে কাজ না হলে প্রশাসনকে খবর পাঠান। অনেক সময় বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরাই তাদের বিপদের কথা কল্যাণীকে জানায়। ছুটির দিনগুলোতে কল্যাণী গ্রামগঞ্জে গিয়ে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সভা ও উঠান বৈঠক করে জনমত গড়ে তোলেন। নারীর প্রতি সহিংস আচরণের প্রতিবাদ জানাতে মানুষকে উৎসাহ দেন। এলাকার কোনো নারী নির্যাতিত হলে কল্যাণী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বিচার পেতে সহায়তা করেন। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বয়স্ক, দুস্থ, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভাতা পেতে সহায়তা করেন তিনি। সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তিনি নিজ নামে গড়েছেন ‘কল্যাণী ফাউন্ডেশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
কল্যাণী হাসান বলেন, ‘কৈশোরে যদি বিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ না করতাম তাহলে আজকের এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। একটি প্রতিবাদ অনেক কিছুর জন্ম দিতে পারে। তাই আমি চাই আমার এলাকার একটি মেয়েও যাতে বাল্যবিয়ের শিকার না হয়। প্রথমদিকে লোকজনের সহযোগিতা কম পেলেও এখন স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সবাই আমাকে সহযোগিতা করেন। তাই সমাজের প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের প্রতি আমার আহ্বান আপনারাও বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।”