দেবহাটার বনবিবির বটতলাকে ঘিরে যত বিশ্বাস, যত আর্তি
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম
সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা দেবহাটা। হাজারও বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করে এই উপজেলা। এই উপজেলাকে নতুন করে পরিচিত করে তুলেছে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক বনবিবির বটতলা। যার সৌন্দর্য প্রকৃতি প্রেমীদের মন কাড়ে।
তিন বিঘা জমির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বট গাছটি। এটির গড় উচ্চতা প্রায় ২০-২২ ফুট। বনবিবির বটতলাকে ঘিরে রয়েছে কয়েক’শ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। বনবিবির বটতলা পাখির কল-কাকলিতে মুখরিত থাকে সব সময়।
জনশ্রুতি রয়েছে, কয়েক’শ বছর আগে এখানে জঙ্গল ছিল। বনে যাওয়ার আগে বনবিবিকে স্মরণ করতো সবাই। সেই থেকেই বনবিবির বটতলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে জায়গাটি। অনেকে বিশ্বাস করে বনবিবিকে স্মরণ করে বনে গেলে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বটগাছকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা সংস্কৃতি। এখানে বনবিবি বা মানীক পীরের একটি থান রয়েছে। প্রতিবছর পহেলা মাঘ বনবিবিকে উৎসর্গ করে বসে হাজুত মেলা। হাজুত মেলায় অনেকে মানত পূরণ করেন। উৎসবের দিন থানে দুধ ঢালেন অনেকে। উৎসব দেখতে আসেন দূর-দূরান্তের হাজারও মানুষ।
হাজুত মেলায় বসে বাহারী রঙের চুড়ি, ফিতা, বাচ্চাদের খেলাধুলার সামগ্রী, সুস্বাদু খাবার, মিষ্টিসহ বিভিন্ন দোকান। দর্শনার্থীরা সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জিনিসও সংগ্রহ করেন মেলা থেকে।
বনবিবির বটতলা সম্পর্কে দেবহাটার বাসিন্দা মনছুর মোল্লা বলেন, “বাপ-দাদার মুখে শুনেছি এই বনবিবির বটতলার ইতিহাস। কয়েক’শ বছরেরও অধিক বয়সী এই বট গাছ। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি প্রতিবছর পহেলা মাঘে এখানে হাজুত মেলা হয়। আমি এই থানের দায়িত্বে আাছি ৫০ বছরের মতো। সকল ধর্মের মানুষ আসে এখানে মানত করার জন্য। অনেকের বিশ্বাস থানে দুধ ঢাললে সকলের মঙ্গল হয়।”
এছাড়া প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বনবিবির বটতলায় পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন নববর্ষ উৎযাপন করার জন্য। নাচ, গান ও আনন্দে মেতে ওঠেন সবাই।
শুধু হাজুত মেলা বা নববর্ষ উদযাপন নয়, সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ প্রতিদিন বেড়াতে আসেন বনবিবির বটতলায়। গবেষণার জন্যও আসেন অনেকে।
বনবিবির বটতলা ঘুরে দেখা যায়, বট গাছটির বিস্তৃত শাখা-প্রশাখায় দর্শনার্থীরা তাদের স্মৃতিচিহ্ন লিখে রাখছেন। কেউবা লিখছেন প্রিয়জনের নাম, কেউবা বাঁধছেন লাল সুতা।
খুলনা জেলার দৌলতপুরের বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, “আমি এসেছি বনবিবির বটতলা দেখতে। মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা যেন স্বাক্ষর বহন করছে বট গাছটির প্রতিটি শাখা-প্রশাখা। গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় খোদাই করে লেখা আছে অসংখ্য নাম। বনবিরি বটতলাকে ঘিরে এতো স্মৃতি দেখে আমি বিস্মিত।”
সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘শঙ্খচিল’র শ্যুটিংও হয় এখানে। সব মিলিয়ে বটবৃক্ষটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় যে কেউ। বনবিবির বটতলা পুলকিত করে মনকে। বটের ছায়ায় প্রশান্তি পায় সকলে। যেন বনবিবির বটতলা হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
প্রসঙ্গত, পৈত্রিক সূত্রে গাছটির মালিকানা পেয়েছিলেন হাজারী পোদ্দার নামের এক ব্যক্তি। তিনি গাছটিসহ জমি তার মেয়ের নামে লিখে দেন। মেয়েকে বিয়ে দেন রাখাল চন্দ্র দের ছেলে ডা. মহাদেব চন্দ্রের সাথে। বর্তমানে গাছটির মালিক তার ছেলে তপন কুমার দে।
যেভাবে যাবেন বনবিবির বটতলায়
বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে সাতক্ষীরা এসে, খুব সহজেই ভ্রমণ করা যায় বনবিবির বটতলায়। সাতক্ষীরা বাস স্ট্যান্ড থেকে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জের বাসে চড়ে নামবেন সখিপুর মোড়ে (ভাড়া ২৫-৩০ টাকা)। সেখান থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে সরাসরি পৌঁছানো যায় দেবহাটা উপজেলার বনবিবির বটতলা।