কদর কমছে গরু মহিষের গাড়ির
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে/যেদিন গাড়িয়াল উজান যায় নারীর মন মোর ছুইরা রয়রে/ হাকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে। গাড়িয়াল ও গাড়ি নিয়ে ভাওয়াইয়া এ গানটির মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান কবিতা রচনা করেছেন কবি সাহিত্যিকেরা। প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের সাথে যেন সে লেখা গুলো একই সুতোয় বাধা। তেপান্তরের মাঠ ঘাট যেখানে অন্যান্য যান্ত্রিক বাহন চলতে অক্ষম জীবনের প্রয়োজনে এমন অসমতল বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয় আজও আমাদের দেশের গাড়িয়ালদের। বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন তারা। গাড়িয়ালদের খবর নিতে চলনবিলের চাটমোহরের কাটেঙ্গা গ্রাম থেকে মাঠের দিকে রওনা হলে সামনেই চোখে পরে মহিষের গাড়ি বোঝাই আমন ধান। কাছে পৌছিলে কানে আসে কিছু অপরিচিত কথা মালা।
‘ঐরে দাব দাব/ দাবনী/ রসা আটে/আপনি/ আটতে কুটতে বছর দুই/ চালে ধরেছে চাল্যা পুই/ দাবলে পরে হব খুশী/ নাম থোব তোর চন্দ্রমুখী’ এমন ছন্দে সুরে সুরে আমন ধান বোঝাই দেয়া মহিষের গাড়ি ঠাসার বাঁশ ও রশির সাহায্যে চেপে শক্ত করে বাধছিলেন পাবনার চাটমোহরের কাটেঙ্গা গ্রামের আলাউদ্দিন মন্ডলের ছেলে আবু বকর সিদ্দিক (৬৪)। নিচে দাঁড়িয়ে অপর দুইজন গাড়ির ধান আটার কাজে সাহায্য করছিলেন আবু বকর সিদ্দিককে। গাড়ি আটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, গাড়ি আটতে কায়দা কৌশল ও শক্তি লাগে। সুরে ও ছন্দে গাড়ি আটলে কাজটি কিছুটা সহজ মনে হয়।
৪২ বছর যাবত মহিষ গাড়ি চালিয়ে আসা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “মহিষের গাড়ির প্রয়োজনীয় উপকরণের মধ্যে রয়েছে চাকা, ধুর্যা, তেতাড়া, জোয়াল, কাকল্যার বাঁশ, সিলম্যা এবং ফরের বাঁশ। বর্তমান প্রতি জোড়া চাকা ৮ হাজর টাকা, ধুর্যা ৪ হাজার টাকা, দুটি তেতাড়া ২ হাজার টাকাসহ পূর্ণাঙ্গ গাড়ি বানাতে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। গরু এবং মহিষের গাড়ির আকার আকৃতি একই। গাড়ি বহনের উপযোগি এক জোড়া মহিষ এখন দেড় লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।” তিনি আরো বলেন, “কার্তিকের মাঝামাঝি দিক থেকে অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন ধান কাটার সময় মাস খানেক গাড়ি চলে। দুরত্ব অনুয়ায়ী প্রতি খেপের জন্য পাই ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। দিনে তিন থেকে ৫টি খেপ দেওয়া যায়। এসময় প্রতিদিন এক হাজার ৫শ টাকার মতো উপার্জন করতে পারি। পৌষ মাসে বোরো ধানের ক্ষেত সমতল করার জন্য মহিষ দিয়ে মই দেয়ার কাজ করি।” আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “চৈত্র বৈশাখ মাসে মাঠ থেকে খেশারী মশুর সরিষা গম রসুন ধনিয়া কালোজিরাসহ অন্যান্য ফসল বহন করে দৈনিক এক দেড় হাজার টাকা পাই। এর কিছুদিন পর জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়ে বোরো ধান বহনের কাজ করি। সব মিলিয়ে বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস গাড়ি চালাই।” তিনি জানান, আগের চাইতে এখন বেশি রাস্তা ঘাট হইছে। অনেক ক্ষেত্রে লছিমন করিমন জমির কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। এসকল যান্ত্রিক বাহনে ফসল পরিবহনে কম সময় লাগায় অনেক জমির মালিক মহিষ গরুর গাড়ির বদলে এসব যানবাহনে ফসল পরিবহনে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে কদর কমছে গরু মহিষের গাড়ির। আবু বকর সিদ্দিকের পরিবারে স্ত্রী, ছেলে, ছেলে বৌসহ চার জন খানে আলা। ৬ শতাংশ বসতবাড়ি ছাড়া নিজের কোন জমা জমি নাই। নিজেদের কাপড় চোপড়, ওষুধপত্র খাবারের যোগানের পাশাপাশি মহিষের জন্য খড় কিনতে হয়। খড়ের দাম বেশি। খড় কিনে খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি নিঃস্ব হতে চলেছেন। সব মিলিয়ে কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন বলে জানান।
চাটমোহরের গুনাইগাছা ইউনিয়নের পৈলানপুর গ্রামের মৃত খয়ের উদ্দিনের ছেলে আলিমুদ্দিন একজন অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ। সম্প্রতি গরুর গাড়িতে ঘাস নিয়ে চরপাড়া এলাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। গাড়ি নিয়ে বাড়ির অদূরের চাটমোহর-অষ্টমনিষা উচুঁ পাকা সড়ক পার হচ্ছিলেন তিনি। গরুর কষ্টের কথা ভেবে তিনি নিজে গাড়ির অগ্রভাগ ধরে টেনে তুলছিলেন। পেছন থেকে ঠেলে সহয়তা করছিল তার ছেলে রুবেল। গৃহস্থলী কাজে প্রায় ৩০ বছর যাবত গরুর গাড়ি ব্যবহার করে আসা এ গৃহস্থ জানান, সাংসারিক কাজে প্রতিনিয়ত গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হয়। মাঠ থেকে ফসল আনা, গরুর ঘাস কেটে গাড়িতে করে বাড়ি আনা, ধানা ভাঙ্গানোর কাজে চালকলে যাতায়াতসহ অনেক কাজে গরুর গাড়ির ব্যবহার করে থাকেন তিনি। আগেকার দিনে বিয়ে, গৃহবধুদের নায়ারে আনা নেওয়াসহ বিভিন্নভাবে গরু মহিষের গাড়ির ব্যবহার হতো। বর্তমান সময়ে যান্ত্রিক বাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গরু মহিষের গাড়ির কদর কমছে বলে জানান তিনি।
চাটমোহরের নিমাইচড়া গ্রামের আমিন (৩৬) বলেন, “বছর খানেক আগে গাড়ি এবং মহিষজোড়া তিন লাখ টাকায় কিনেছি। সপ্তাহে দুই দিন মির্জাপুর হাট করি। বিশ পঁচিশ মণ করে মালামাল বহন করা যায়। গ্রাম থেকে মানুষের ধান গম সরিষা খেসারি মশুর হাটে পৌছে দেই। বিনিময়ে পাই মণ প্রতি বিশ টাকা। গ্রামের মানুষ আগেই বলে রাখে তাদের মালামাল হাটে পৌছে দেবার জন্য। হাটে গিয়ে মালামাল আনলোড করে নির্ধারিত স্থানে গাড়ি রাখি। হাটুরেরা মালামাল কিনে গাড়িতে দেয়। ফের সেগুলো বাড়ি নিয়ে আসি।” তিনি আরও বলেন, “সব সময় গাড়ি পুরো লোড হয় না। প্রতি হাটে সাত আটশ’ টাকা থাকে। নিজের পাঁচ বিঘা জমি আছে। মাঠ থেকে নিজের গাড়িতে করে ফসল আনি। পাশাপাশি অন্যদের ফসল এনে দেই। বিনিময়ে তারা ফসল দেয়। চার মেয়ে আমার। বড় মেয়ে আলমিনা পঞ্চম শ্রেণীতে দ্বিতীয় মেয়ে আল্পনা তৃতীয় শ্রেণীতে পরে। আর দুজন ছোট। পাঁচ বিঘা জমি এবং মহিষ গাড়ির উপর নির্ভর করে ছয় সদস্যের সংসার পরিচালনা করে আসছি।”