গ্রাম বাংলার মাছ ধরার ঐতিহ্যবাহী উৎসব পলো বাওয়া

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং

বাংলাদেশকে নদী-মাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। খাল, বিল, নদী, নালা অথবা হাওর-বাওর নেই বাংলাদেশে এমন এলাকা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এগুলো আমাদের দেশের সম্পদ, এক শ্রেণীর মানুষের গোটা জীবন চলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে। বিশেষভাবে জেলে জনগোষ্ঠী এবং এসব জলাধারের তীরবর্তী জনগোষ্ঠীর জীবন এসব প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে প্রাপ্ত সম্পদের উপর নির্ভরশীল। জলজ সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম সম্পদ হল মাছ। মাছ ছাড়া অন্যান্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে শামূক, ঝিনুক, শাপলা, শালুক, সিঙ্গারাসহ বৈচিত্র্যময় অসংখ্য অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ। এক কথায় বলা চলে এসব প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো নিরাপদ খাদ্যের এক একটি বিশাল ভান্ডার। এদেশের জলাশয়গুলোতে বর্ষার শুরুতে বৈচিত্র্যময় মাছের প্রজনন ঘটে। গোটা জলাশয়ে এসব মাছ বিচরণ করে এবং প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে। বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়গুলো থেকে মানুষ স্বাধীনভাবে মাছ ধরে। জলাশয়গুলো থেকে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলায় বেশ কিছু উৎসব হয়। উৎসবগুলোর মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো পলো বাওয়া।

IMG_20171105_103345-W600
বর্ষা মৌসুম শেষে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর (ছোট ছোট কম গভীরতার নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর-বাওর) পানি শুকিয়ে হাটু বা কোমর পর্যন্ত নেমে গেলে মাছ ধরার ঐতিহ্যবাহী পলো উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। পলো মূলতঃ বাঁশের কাঠি ও এক ধরনের চিকন জংলি লতা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার উপকরণ। তবে বর্তমান সময়ে সেসব লতা সহজপ্রাপ্য না হওয়ায় চিকন তার বা লাইলনের সূতা দিয়ে বাঁশের তৈরি কাঠি বিশেষ কায়দায় বেঁধে পলো তৈরি করা হয়। কাঁচের পানপাত্র উল্টে রাখলে যেমন দেখায় পলো দেখতে ঠিক অনুরূপ। পলো বাওয়া মূলতঃ এলাকার অনেক লোক একত্রিত হয়ে দল বেঁধে গ্রামীণ ও প্রাচীন মাছ ধরার উপকরণ পলো (বাঁশের তৈরি এক ধরনের খাঁচা আকৃতির) দিয়ে শত শত লোকের একদিক থেকে সারি বেঁধে চিৎকার করে ডাক ভাংতে ভাংতে মাছ ধরা। সারিবদ্ধভাবে পলো ফেলে সকলে সামনের দিকে ডাক ভেঙে আগ্রসর হওয়ায় মাছগুলো পেছনের দিকে যেতে না পেরে সারিবদ্ধ লোকদের সামনে দিয়ে লাফালাফি করতে করতে পেছনের দিকে ছুটতে থাকে। এ সুযোগে শিকারীরা বড় বড় মাছগুলো লক্ষ্য করে তাদের পলো নিক্ষেপ করে। কোন মাছ পলোতে আটকা গেলে মাছটি পলোর ভেতর লাফালাফি করতে থাকে, আর শিকারিরা পলোর উপর দিকের খোলা অংশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছটি ধরে জালের থলি বা রশি দিয়ে কৌশলে আটকে কোমড়ে বেঁধে রাখে। পলো বাওয়া দলের পেছনে পেছনে কিছু লোক ছিপ জাল, ঠেলা জাল ও ঝাকি জাল (কোথাও কোথাও কইন্যা জাল/তৌওরা জাল বলা হয়) দিয়ে লাফালাফি করে পালিয়ে যওয়ার চেষ্টারত ছোট ছোট (পুঁটি, চাপিলা, লাঠি, চিংড়ি ইত্যাদি) মাছগুলো ধরে।

IMG_20171105_103600-W600
পলো উৎসবটি অনুষ্ঠানের জন্য এলাকার (কয়েকটি গ্রাম বা উপজেলার লোক হতে পারে) পলো শিকারীরা প্রতিটি গ্রামের পলো শিকারীদের মুখে মুখে প্রচার করে পলো বাওয়া উৎসবের নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণ জানিয়ে দেয়। নির্ধারিত দিনে বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রামের পলো শিকারিরা নিজ নিজ পলো নিয়ে নির্দিষ্ট জলাশয়ে উপস্থিত হয় এবং ভাটি থেকে উজানের দিকে সারিবদ্ধভাবে পলো ফেলতে ফেলতে অগ্রসর হয়। এসময় শিকারীরা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে ডাক ভাংতে থাকে। পলো ফেলার শব্দ ও মানুষের চিৎকারে পানিতে থাকা মাছগুলো আতঙ্কিত হয়ে লাফালাফি করলে মাছগুলো লক্ষ্য করে পলো দিয়ে সেগুলো আটকে ধরা হয়। পলো উৎসবে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের কেউ কেউ মাছ না পেয়ে খালি হতে বাড়ি ফিরে, আবার কেউ কেউ অনেকগুলো মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে। তবে সকলেই উৎসবে খুব অনন্দ করে। অসংখ্য লোক জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে পলো বাওয়া উৎসব উপভোগ করে। সাধারণত পেলো বাওয়ার মাধ্যমে বোয়াল, শোল, গজার, টাকি, রুই, কাতলা ও কার্প জাতীয় মাছ ধরা হয়। পলো বাওয়া উৎসবটি যেহেতু প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে অনুষ্ঠিত হয়, তাই এতে অংশগ্রহণের জন্য কোন ফি এবং প্রাপ্ত মাছের কোন অংশ কাউকে দিতে হয় না।

IMG_20171105_103418-W600
পলো বাওয়া একটি কঠিন কাজ এবং এর জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়, দূর্বল ও কম শক্তির লোক এতে অংশগ্রহণ করতে পারেনা। যেহেতু কোমর পানি ভাংতে হয় এবং দলের সাথে এক সাড়িতে অগ্রসর হয়ে পলো ফেলতে ফেলতে এগোতে হয় তাই এক্ষেত্রে পলো শিকারির অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। পানিতে পলোর ওজন বেড়ে যাওয়ায় এবং ঘন ঘন পলো উঠিয়ে পানিতে ফেলা অনেক কষ্টকর। অন্যদিকে একজন শিকারি যদি সারি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পিছিয়ে পড়ে তাহলে মাছগুলো সেই ফাঁক দিয়ে শিকারিদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

IMG_20171105_103652-W600
সাম্প্রতিক সময়ে (৬ অক্টোবর, ২০১৭) নেত্রকোনা সদর উপজেলার দুপদইল ও কান্দইল বিলে (প্রায় ১.৫কি.মি. দীর্ঘ) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মাছ ধরার ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব। নেত্রকোনা সদর, আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলার আনুমানিক ৩০টি গ্রামের প্রায় ২৫০০ পলো শিকারি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। সকাল ৮টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত উৎসবটি চলে। পলো বাওয়া উৎসবে শিকারিরা বোয়াল, রুই, কাতলা, শোল, কার্পু, টাকি ইত্যাদি প্রচুর মাছ ধরতে সক্ষম হয়। কিছু শিকারিকে খালি হাতে ফিরতে দেখা গেলেও তাদের মনে ছিল অনাবিল আনন্দ। যারা মাছ পেয়েছিল তাদের মধ্যে দেখা গেছে বাধ ভাঙা আনন্দ। তবে প্রায় তিন ঘণ্টা কোমর পানিতে পলো বাওয়ার ফলে অনেক শিকারীকে শারীরিকভাবে পরিশ্রান্ত দেখা গেছে। অংশগ্রহণকারী শিকারিরা জানান, পানি আরও কিছুটা নেমে গেলে শোল মাছ ধরার জন্য পুনরায় পলো বাওয়ার উৎসব আয়োজন করা হবে।

IMG_20171105_103707-W600
বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো লিজ দেওয়ায় এবং জবর দখল করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দ্রুত বর্ধনশীল জাতের মাছ চাষ করায় মুক্ত জলাশয়ের অভাবে পলো বাওয়া উৎসবটি বিলুপ্তির উপক্রম। তবে এখনও যেসব এলাকায় মুক্ত জলাশয় রয়েছে এবং সেগুলো লিজমুক্ত ও দখলমুক্ত, সেসব এলাকায় এখনও পলো বাওয়া উৎসবটি অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। পলো বাওয়া উৎসবটির ফলে বেশ কয়েকটি উপজেলার এবং অনেকগুলো গ্রামের মানুষ মাছ ধরার জন্য একত্রিত হয়। ফলে অংশগ্রহণকারী গ্রামগুলোর মানুষের মধ্যে পরিচিত ও পারস্পারিক সম্পর্ক এবং পারস্পারিক তথ্য আদান-প্রদান ও সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়। এর ফলে অংশগ্রহণকারীরা একদিকে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে অন্যদিকে একদিনের জন্য হলেও তারা প্রাণ খুলে বিনোদন করতে পারেন। তাই ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার গ্রামীণ এই পলো বাওয়া উৎসবটি টিকিয়ে রাখতে হলে সমস্ত প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো (নদী, খাল, বিল, হাওর ও বাওর) লিজমুক্ত করে অবমুক্ত করে দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে বেড় জাল, কারেন্ট জাল, বিষ ও সেচ দিয়ে মাছ ধরা। তবেই রক্ষা পাবে স্থানীয় জাতের মাছ বৈচিত্র্য এবং সমৃদ্ধ হবে মাছ ধরার গ্রামীণ পলো বাওয়া উৎসবটি।

happy wheels 2

Comments