সাম্প্রতিক পোস্ট

বিলুপ্ত হচ্ছে আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি

ইকবাল কবীর রনজু, চাটমোহর, পাবনা থেকে

আমরা এবং আমাদের পূর্ব পুরুষেরা আমাদের নিজস্ব ভাষায় পানিকে বলতাম পেনিয়া। তেমনিভাবে মাছকে মেছরি, উকুন কে ঢিলা, চুল কে চুর, ঝাঁড়–কে বেরনী, চোখ কে আইক, পা কে গড়, আঙ্গুল কে এংড়ি বলতাম। আমাদের ভাষা প্রভাবিত করছে আমাদের সন্তানদের। তারা বাড়িতে আমাদের নিজস্ব ভাষা সাদরীতে কথা বললেও স্কুলে এ ভাষার প্রচলন নেই। ফলে আমাদের সন্তানরা কখনো সাদরী আবার কখনো বাংলায় কথা বলছে। শিশুদের বাংলা নির্ভরতা বাড়ায় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব ভাষা। এলাকার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ভাষায় পাঠদান হয় না। এ ভাষার নেই কোন শিক্ষকও নেই। গত ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার কথাগুলো বলছিলেন পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়াল ইউনিয়নের বাঘলবাড়ি কৈ গ্রামের আদিবাসী যুবক, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ পাবনা জেলা শাখার সভাপতি রাম প্রসাদ মাহাতো।

pic-3 Adibasi students

তিনি জানান, চাটমোহরের হরিপুর, কাজীপাড়া, উথুলী, গুনাইগাছা ও ফৈলজানায় কিছু আদিবাসী পরিবারের বসতি থাকলেও পৌর সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরের জনপদ হান্ডিয়ালের বাঘলবাড়ি, বাঘলবাড়ি কৈ, কেশবপুর, বিরায়নগর ও পার্শ্ববর্তী চন্ডীপুর এলাকায় বাস করে অধিক সংখ্যক আদিবাসী পরিবার। এ পাঁচ গ্রামে অন্তত দুইশ পঁচিশ আদিবাসী পরিবার বসবাস করে আসছেন সুদীর্ঘকাল থেকে। এ এলাকায় মাহাতো, মুন্ডা, লহড়া, শিং, মুন্ডারী ও পাহান এ ছয় সম্প্রদায়ের বসতি থাকলেও মাহাতো সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ।

পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে তিনি জানান, তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা বন্য পশু শিকার করে ভক্ষণ করতেন ও বিক্রি করতেন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় এবং শিকার প্রাপ্তি সহজলভ্য না হওয়ায় এখন তাঁরা আর শিকারের খোঁজে বের হয় না।

পরিবার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমাদের পরিবার প্রথা পিতৃতান্ত্রিক হলেও অর্থ উপার্জনে পরিবারে পুরুষের তুলনায় মেয়েরা মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। অধিকাংশ আদিবাসী পরিবার দরিদ্র হওয়ায় জীবিকার অন্বেষণে ভোর হতে না হতেই আদিবাসী মেয়েদের দূর দূরান্তে ছুটতে হয় কৃষিশ্রম বিক্রি করতে। পুরুষেরা কৃষি এবং দোকানপাটে কাজ করেন।”

pic-5 Adibasi nari purush

এ এলাকার আদিবাসীরা সনাতন ধর্মের অনুসারী। ধর্মীয় উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেন সবার সাথে। সনাতন ধর্মের দূর্গা পূজা, কালী পূজাসহ অন্যান্য পূজা পার্বন পালনের পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতির পূজা করে থাকেন। প্রধান ধর্মীয় উৎসব করম পূজা বা ডাল পূজা। ভাদ্র মাসব্যাপী চলে এ পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পূর্ণিমা তিথীতে পূজা বেশি হয়। এ ছাড়াও নিজস্ব সংস্কৃতির গোহাল পূজা বা সহরাই পূজা, কুসংস্কার ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসী হেতু ভূত পূজা, স্বামি ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পারিক ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে ভিতর ঘরের পূজা (মারওয়া পূজা, বুড়াবুড়ি পূজা), করে থাকেন। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অনুষ্ঠানাদীতে আদিবাসী নাচ গানের আয়োজন করা হয় বলে জানান তিনি।

একই গ্রামের অধিবাসী আদিবাসী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহকারী সাধারণ সম্পাদক দিপক কুমার মাহাতো জানান, বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত এ এলাকার আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেনি আজও। এর প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দৈন্যতা। বিশেষত শিক্ষার অবস্থা খুবই নাজুক। পরিবারের বড়রা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। অনুকরণ প্রিয় শিশুরা এ মাতৃভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করে। স্কুলে তো আর এ ভাষায় কথা বলা যায় না। ভাষাগত সমস্যার কারণে স্কুলে আর দশটা বাচ্চার সাথে অনেকে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। এজন্য স্কুলে গমনোপযোগী অনেকে স্কুলে যায় না।

pic-1 kali mondir

অতীতে আদিবাসী পরিবারের অনেকে ব্যাপকভাবে মাদক গ্রহণ করলেও তাঁরা অনেক প্রচেষ্টায় তাদের ছেলে মেয়েদের মাদকের করাল গ্রাস থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন খাপ খাওয়ানোর। অনগ্রসর এ জাতিগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে বেসরকারি সংস্থা ব্রাক স্থাপন করেছে আদিবাসী ব্রাক স্কুল। এখন অনেক আদিবাসী ছেলে মেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ছে। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষা ও গ্রহণ করছেন। তবে সে সংখ্যা খুব বেশি নয়।

আদিবাসী কাঞ্চন মাহাতো পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক। নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো এ এলাকা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় আদিবাসীদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য নির্ভর করেন কাঞ্চন মাহাতোর উপর। কাঞ্চন মাহাতো জানান, অশিক্ষার কারণে এ এলাকার আদিবাসীরা পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন নয়। পাশাপাশি দারিদ্রতার কারণে এরা পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না। ফলে অনেক আদিবাসী পুরুষ নারী শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। সহজেই রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় তারা।

অতীতে ব্যাপকভাবে বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটলেও ক্রমশই তা কমছে। স্বগোত্রের মধ্যে বিবাহের রেওয়াজ নেই। একই সম্প্রদায় হলেও বিবাহের ক্ষেত্রে গোত্র ভিন্নতা থাকাটাই এখানকার স্বাভাবিক নিয়ম। আর অন্য সম্প্রদায় হলে গোত্র নির্ভরতা দেখা হয় না।

এ এলাকার আদিবাসীদের উপাসনার জন্য গ্রামের পূর্ব উত্তর কোনে রয়েছে একটি ভাঙাচোরা জীর্ণ শীর্ণ কালি মন্দির এবং একটি পাটকাঠি দিয়ে তৈরি দূর্গা মন্দির। পাশেই রয়েছে আদিবাসী কমিউনিটি সেন্টার। মন্দির ও কমিউনিটি সেন্টারে যাবার রাস্তা নেই বললেই চলে। কোনমতে পায়ে হেটে চলার একটি পথ রয়েছে। ঝড় ঝাপটা উপেক্ষা করে কোনমতে টিকে আছে চাটমোহরের আদিবাসী পরিবারগুলো। আদিবাসীরা মাথা ঊচু করে দাঁড়াতে না পারলেও মন্দির প্রাঙ্গনে কালের সাক্ষী হিসাবে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন একটি বট বৃক্ষ। এমনিভাবে মাথা উচু করে দাঁড়াতে, আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে আদিবাসীদের জন্য প্রয়োজন সরকারিও বেসরকারি পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা।

happy wheels 2

Comments