পরিবেশ রক্ষায় কিশোরীদের ক্ষুদ্র উদ্যোগ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
‘পরিবেশ আমাদের জীবন, আমাদের পরিবেশ আমরা রক্ষা করবো’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে পরিবেশ রক্ষার এ অঙ্গীকার করেন নেত্রকোনা জেলায় কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামে অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের সদস্যরা।
এলাকা উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চা ও জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনটি প্রায় এক বছর যাবত এলাকায় বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করে আসছে। গ্রামের কিশোরীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে গ্রামের অন্যান্য জনগোষ্ঠীদের এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে উদ্ধুদ্ধ করছে। সংগঠনটি বিশ্বাস করে প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহযোগী মনোভাব ও যত্নশীলতার মতো মানবীয় গুণাবলী শক্তিশালী হয়।
কিশোরীরা অনুধাবন করে যে, তাদের এলাকায় ফলের গাছ ও ঔষধি গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে করে শিশুসহ মায়েরা পুষ্টির অভাবজনিত বিভিন্ন রোগ আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের জনগোষ্ঠী দেশীয় ও স্থানীয় জাতের ফলের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কিশোরী সংগঠনটি এলাকায় স্থানীয় ও দেশীয় প্রজাতির ফল ও ঔষধি গাছের বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে গ্রামে ঔষধি ও স্থানীয় জাতের ফলের চারা রোপণের উদ্যোগ নেয়।
কিশোরী সংগঠনটির এমন মহতি উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল হামিদ কবিরাজ। তিনি ২০ জন কিশোরীকে বিনামূল্যে ৬ জাতের ৫০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদের চারা দিয়ে সহযোগিতা করেন। তিনি সংগঠনের সদস্যদেরকে ঔষধি বাগান সৃজনের জন্য নিম, হরতকি, বহেরা, অর্জুন, ঘৃতকাঞ্চন ও শতমূল গাছের চারা প্রদান করেন এবং ঔষধি গাছগুলোর সাথে কিশোরীদের পরিচিতি করান। বিভিন্ন রোগবালাই প্রতিরোধ ও নিরাময়ে এস ঔষধি গাছের ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। বৃক্ষ প্রেমিক কবিরাজ আব্দুল হামিদ ২০ জন কিশোরীর বসতভিটায় কিশোরীদের সাথে অংশগ্রহণ করে ঔষধি গাছের চারাগুলো রোপণ করে দেন।
এ বিষয়ে সংগঠনের সদস্য কিশোরী কমা আক্তার তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “গাছ আমাদের বন্ধু, তাই আমরা এ বছর থেকে প্রতিবছর প্রত্যেকে ৫টি করে ফলের এবং ঔষধি গাছের চারা লাগাবো ও অন্যদেরকেও বৃক্ষ রোপণে উৎসাহিত করব। জলবায়ু মোকাবেলা করতে হলে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে এবং সংগঠনের সভায় বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে সকলকে উদ্বুদ্ধ করব।” গ্রামের প্রবীণ নারী সুফিয়া আক্তার বলেন, “আগে আমাদের অসুখ-বিসুখ কম হইত। বাড়ি চারপাশে থেকে ঔষধি লতা-পাতা সংগ্রহ করতাম, খাইতাম, অন্যদের অসুখ হলে বলতাম খাওয়া জন্য। তহন এত ডাক্তার ছিল না। প্রত্যেক সিজনে, আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, সবরী (পেয়ারা), লিচু, নারিকেল, ডাব কোন দিন কিননা খাইতাম না। নিজেও খাইতাম, পাখিরাও খাইত, মেয়ে ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে পাঠায়তাম। এহন এইগুলো আর নাই, দিন দিন সব কমইয়া গেছে। তাই আজ থেকে আমরা সবাই মিললা গাছ লাগাব আর পরিবেশ সুন্দর রাখব।”
এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও পরিবেশ সুরক্ষায় এবং ঔষধি উদ্ভিদের বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে কিশোরী ও যুবদের বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগটি খুবই প্রশংসনীয়। বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে গ্রামের কিশোরীরা প্রমাণ করেছে যে, তারা পরিবেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। কিশোরীদের উদ্যোগ বাস্তবায়নে বারসিক এবং বৃক্ষ প্রেমিক কবিরাজ আব্দুল হামিদ এর সহায়তায় এলাকার বর্তমান প্রজন্ম প্রাকৃতির সাথে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে এবং তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে বলে আশা করছি।
এখন জুলাই মাস, বৃক্ষ রোপনের জন্য এই মাসটি উত্তম সময়। আসুন আমরা সকলেই নিজ নিজ গ্রাম, পাড়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পতিত জমি ও রাস্তার ধারে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণ করি এবং আগ্রাসী প্রজাতিগুলো বর্জন করি। নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখি। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আমরা পরিবেশ সুরক্ষায় সক্ষম হব।