মানুষের পাশে দাঁড়াই, মানবতার হাত বাড়াই
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
বারসিক বৈচিত্র্য, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী সেই সমাজেরই একটি অংশ। বারসিক মনে করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে সহাবস্থানে অবস্থান করবে। প্রতিটি জাতিস্বত্ত্বা তার অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে সম্মানের সাথে টিকে থাকবে। ‘মানুষের পাশে দাঁড়াই, মানবতার হাত বাড়াই’ শ্লোগানকে সামনে রেখে সম্প্রতি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সাথে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বারসিক। আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী কামরুল হুদা সেলিম।
বারসিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জ জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর বাস রয়েছে। ‘আলোমতি’র বয়স ৬০ বছর। যার জন্ম ফরিদপুর জেলায়। ৩ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে আলোমতি সবার বড়। আলোমতির ভাষ্য, ‘যখন পবিারের সবাই জানতে পারলো আমি হিজরা তখন আমাকে আমার মা-বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিল। তারা ভাবলো আমি বাড়িতে থাকলে আমার অন্য দুই বোনের বিয়ে হবে না। কারণ সবাই ভাববে হিজড়ার বোন সেও যদি হিজড়া হয়। সমাজের মানুষের ভয়ে আমার আপনজনেরা আমাকে পর করে দিল।’ আলোমতি বলেন, ‘তখন থেকে আমি হিজড়াদের সাথে থাকছি। প্রায় ৩ যুগ ধরে আমি মানিকগঞ্জে আছি। মানিকগঞ্জের পশ্চিম দাশড়া গ্রামে আমরা ১২ জন একসাথে থাকি। বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্নজন থাকে। মানিকগঞ্জ জেলায় ৮০ জনের মত হিজড়া আছে। মানিকগঞ্জের ৭ টি উপজেলায় ৭ জন দলনেতা আছে। আমি এই জেলার দলনেতা। সবাই আমাকে ভালোবেসে “গুরুমা” বলে ডাকে।’ আলোমতি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপি করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে বিভিন্ন পেশার নিম্ন আয়ের মানুষেরা আজ সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের জীবন এখন আরো বেশি কষ্টময়। মহামারী করোনায় সারা দেশে সবকিছু লকডাউন হয়ে যায়। আলোমতিরা পড়েন বিপদে। তাদের উপার্জানের সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। বসে বসে কে খাওয়াবে তাদের। অনেকেই খেতে না পেয়ে তার নিজ নিজ জেলায় চলে যেতে বাধ্য হয়।’
বারসিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে চায়। বাড়িয়ে দেয় মানবতার হাত। বারসিক উদ্যোগ নেয় তাদের জন্য কিছু করার। কিছুদিন আগে বারসিক ও উদীচি মানিকগঞ্জ আলোমতির ৬০তম জন্মদিন উদযাপন করে। সেখানে মানিকগঞ্জের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী কামরুল হুদা সেলিম তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য ৫০০০ টাকা প্রদান করার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে তিনি সেই টাকা তুলে দেন বারসিক’র হাতে। করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ালো মেয়র ও বারসিক। গত ৫ জুন ঘরোয়া পরিবেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে মেয়র মহোদয় আলোমতির হাতে ৫০০০ টাকা তুলে দেন। চরম সংকটের মুহূর্তে ৫০০০ টাকা হাতে পেয়ে আলোমতির অভিব্যক্তি, “এই বিপদের সময় আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। অনেকেই আমাদের দেখলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, আমরা যে অটোতে চড়ি তারা চড়তে চায়না। আমাদের সাথে মিশে না, কথা বলে না। সেইখানে আপনারা আমার জন্মদিন পালন করেছেন, আমাকে সম্মান দিয়েছেন। অনেকে অনেক কথা দেয় কিন্তু কথা রাখেনা। আপনারা রেখেছেন। বারসিককে ধন্যবাদ জানাই তারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।’
সভাপতির মানিকগঞ্জের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী কামরুল হুদা সেলিম বলেন, ‘আমি বারসিককে ধন্যবাদ জানাই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার জন্য। তারা আলোমতির জন্মদিন পালন করেছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই জন্মদিনে উপস্থিত থেকে কেক কাটার। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ৫০০০ টাকা দেওয়ার। আজ বারসিক’র আয়োজনে সেই টাকা আলোমতির হাতে তুলে দিতে পারলাম। আমার নিজেরও ভালো লাগছে। শুধু আজকে নয় আলোমতিদের যে কোন প্রয়োজনে যে কোন সময় আমার কাছে আসলে আমি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব।’
দেশের এই সংকটকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের শিকার এই জনগোষ্ঠী। কেননা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেই প্রতিদিনের রোজগার প্রতিদিন করেন। যাদের সবাই এখন উপার্জনহীন জীবন অতিবাতিহ করছেন। আসুন আমরা মানবিক হই মানবতার হাত বাড়াই সেইসব জনগোষ্ঠীর প্রতি।